বালুরঘাট ব্লকের মাদুর বুনন শিল্পীদের জীবন যুদ্ধের কহানী।

দঃ দিনাজপুর, নিজস্ব সংবাদদাতাঃ- মাদুর বুনে সংসার চালাচ্ছেন বালুরঘাট ব্লকের দোললা, ডুমোইর,মালঞ্চা, অমৃতখন্ড সহ জলঘর গ্রামের মহিলারা। বালুরঘাট ব্লকের মাদুর বুনন শিল্প ক্ষুদ্র কুটির শিল্প হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এই ব্লকের প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন মহিলা মাদুর বোনার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছেন। তবে মহিলাদের আক্ষেপ রাজ্য সরকার তাদেরকে আর্থিকভাবে সাহায্য করলে বা লোনের ব্যবস্থা করলে তাহলে আরো ভালোভাবে তারা এই কাজ করতে পারতেন। কিছুদিন আগে এই সমস্ত মহিলারা তাদের বিভিন্ন ডকুমেন্টস সরকারের কাছে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা শিল্প দপ্তরের মাধ্যমে জমা দিয়েছেন। তাদের আশা সরকার নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন।
মাদুর বোনার জন্য কাঁচামাল হিসাবে জমিতে এক ধরনের বিশেষ ফসল উৎপাদিত হয় যেখান থেকে মাদুরকাঠি প্রস্তুত হয়। এছাড়াও মাদুর তৈরি করতে সুতোর প্রয়োজন হয়। বাঁশের তৈরি ঘরোয়া ভাবে তৈরি একটি যন্ত্রের মাধ্যমে মাদুর বোনা হয়। প্রথমে জমিতে মাদুর বোনার জন্য ফসল লাগাতে হয়। সেই ফসল ওঠার পর তা রৌদ্রে শুকিয়ে সেখান থেকে মাদুরের জন্য কাঠি বের করা হয়। গ্রীষ্মকালে এই মাদুরের চাহিদা অত্যন্ত বেশি হয়। স্থানীয় পাইকারেরা এই সমস্ত মহিলাদের কাছ থেকে মাদুর নিয়ে বালুরঘাট তথা দক্ষিণ দিনাজপুরের বিভিন্ন হাট-বাজার ইত্যাদি স্থানে গিয়ে বিক্রি করেন। মাদুর শিল্পীরা জানালেন, এই মাদুর বিভিন্ন জেলাতেও সরবরাহ করা হয়। পার্শ্ববর্তী উত্তর দিনাজপুর, মালদা এমনকি শিলিগুড়িতেও এই মাদুর বালুরঘাট ব্লক থেকে সরবরাহ করা হয়।
মাদুর বোনার সঙ্গে যুক্ত মহিলা লিপি দেবনাথ জানালেন, “আমরা দিনে প্রায় চার থেকে পাঁচটা মাদুর তৈরি করি। সাধারণত মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন মাস পর্যন্ত এই মাদুরের চাহিদা সবচেয়ে বেশি হয়। মাদুর বিভিন্ন আকৃতির হয় অর্থাৎ ছোট, মাঝারি এবং বড়। বিভিন্ন দামে এই মাদুরগুলি পাইকারদের কাছে আমরা বিক্রি করি। ৫০ টাকা থেকে ছোট মাদুর, মাঝারি মাদুর ১০০ টাকা এবং তার থেকে বড় মাদুর ১৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে পাইকারদের কাছে আমরা বিক্রি করি। আমরা নিজেরা কোন হাট বা বাজারে মাদুর নিয়ে যাই না। পাইকারদের মাধ্যমে আমরা এই মাদুর বিক্রি করি। সরকার যদি আমাদেরকে লোনের ব্যবস্থা করত বা কোন রকম ভাবে আর্থিক সাহায্য দিত তাহলে আমাদের অনেক উপকার হত।”
বালুরঘাট ব্লকের দৌললা গ্রামের ভানুবালা দেবনাথ বলেন, “বর্তমানে মাদুর শিল্পটি সরকারি অনুদানের অভাবে ধুঁকছে। আমরা বংশপরম্পরায় মাদুর বোনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। মাদুর বোনার জন্য কাঁচামাল অর্থাৎ যেখান থেকে মাদুরকাঠি বের করা হয় তা আমাদের গ্রামেই একটি বিশেষ ফসলের সাহায্যে উৎপাদিত হয়। সেই জন্য কাঁচামালের জন্য আমাদের বাইরে কোথাও যেতে হয় না। এর সঙ্গে লাগে সুতো যেটা অবশ্য আমরা স্থানীয় বাজার থেকেই পেয়ে যাই। সব মিলিয়ে মাদুর বুনে আমরা আমাদের সংসার ভালোভাবেই চালাতে পারছি।”
আরেক মাদুর শিল্পী ভক্তি দেবনাথ বলেন, “বর্ষাকালে মাদুরের চাহিদা বিশেষ হয় না। আমরা চেষ্টা করি গ্রীষ্মকালে দিনে যতটা বেশি সম্ভব মাদুর তৈরি করে তা স্থানীয় পাইকারদের কাছে বিক্রি করে সেই টাকা জমিয়ে রাখা। এই টাকা দিয়ে আমরা সারা বছর আমাদের সংসার চালাই। সরকারের কাছে আমরা আগে আর্থিক অনুদানের জন্য আবেদন জানিয়েছি কিন্তু এখনো পর্যন্ত কিছু পাওয়া যায়নি। আমাদের পরিবারের সমস্ত মহিলারা মাদুর বোনার সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছেন। আমাদের এখানকার মাদুর দক্ষিণ দিনাজপুর তথা আশেপাশের সমস্ত জেলাগুলোতে সরবরাহ করা হয়। শহরাঞ্চলের লোকেদের মধ্যেও আমাদের তৈরি মাদুরের চাহিদা যথেষ্টই রয়েছে।”
স্কুল পড়ুয়া দৌললা গ্রামের পিউ দেবনাথ পড়াশুনার পাশাপাশি মাদুর তৈরি করে পরিবারকে সাহায্য করছে। পিউ বলে, “আমি প্রতিদিন পড়াশোনার পাশাপাশি মাদুর বুনে আমার বাবা মাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করি। আমি চেষ্টা করি পড়াশোনাকে অবহেলা না করে যাতে মাদুর বুনে আমার পরিবারকে সাহায্য করা যায়। মাদুর তৈরি করার জন্য যদি কোনরকম যন্ত্রের সাহায্য নিতে পারতাম তাহলে আমি দিনে আরো বেশি করে মাদুর তৈরি করতে পারতাম। আমি আশা করছি সরকার এ ব্যাপারে আমাদেরকে সাহায্য করবে। আমি সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে রাজ্য সরকারের কাছে আর্থিক অনুদান পাওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।”
এ বিষয়ে স্বপন কুমার প্রামানিক, জেনারেল ম্যানেজার ইনচার্জ, ডিস্ট্রিক্ট ইন্ডাস্ট্রিস সেন্টার, দক্ষিণ দিনাজপুর জানালেন, “আমরা ২০২১- ২০২২ সালে অমৃতখন্ড, দৌললা এবং মালঞ্চা গ্রামে সার্ভে করেছিলাম। সেখানকার মাদুর বোনার সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম যাতে তারা সরকারি আর্থিক সাহায্য পাবার জন্য তাদের নাম আমাদের কাছে নথিভুক্ত করেন। আমাদের লক্ষ্য ছিল মালঞ্চা গ্রামে মাদুর শিল্পীদের জন্য একটা ক্লাস্টার তৈরি করা। এর জন্য ৪০ থেকে ৫০ জন মাদুর শিল্পীদের একসাথে আবেদন জানানো জরুরি ছিল কিন্তু পরবর্তীকালে চার থেকে পাঁচ জন মাদুরশিল্পী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। মাদুর শিল্পীদের একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা না হলে এরকম ক্লাস্টার তৈরি করা আমাদের পক্ষে অসুবিধা জনক। আমরা আশা করছি মাদুর শিল্পীরা আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসবেন, তাহলে আমরা নিশ্চয়ই রাজ্য সরকারের যে সমস্ত সামাজিক স্কিম রয়েছে তার মাধ্যমে তাদেরকে সাহায্য করতে পারব। আমরা বলেছি আমাদের কাছে এসে তারা তাদের নিজেদের নাম সরকারিভাবে নথিভূক্তকরণ এর জন্য, কারণ সরকারিভাবে তাদের নাম নথিভূক্তকরণ না হলে তাদেরকে সরকারি সাহায্য দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা রাজ্য সরকারের কাছে ইতিমধ্যেই এই সমস্ত মাদুর শিল্পীদের বিষয়ে জানিয়েছি। যদি পরবর্তীকালে সরকারের তরফ থেকে এই সমস্ত মাদুর শিল্পীদের কোনরকম টুল-কিটস দেওয়া হয়, তাহলে আমরা সেগুলো তাদের হাতে তুলে দেব। আমরা মাদুর শিল্পীদের সাহায্য করার জন্য আন্তরিক। এখন তাদের উচিত এই কাজে এগিয়ে আসা। তাহলেই হয়তো মাদুর শিল্পীদের প্রকৃত সাহায্য করা হবে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *