ভারতের মাটিতে এমন অনেক ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে, যেগুলো শুধু ইট-পাথরের ধ্বংসাবশেষ নয়, বরং প্রাচীন সভ্যতা ও জ্ঞানের অমূল্য নিদর্শন বহন করে চলেছে। বিহারের ভাগলপুর জেলার অন্তর্গত বিক্রমশীলা মহাবিহার এমনই এক স্থান, যা এককালে সমগ্র ভারতবর্ষে শিক্ষা ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির এক মহাকেন্দ্র ছিল।
🕰️ ইতিহাসের পাতায় বিক্রমশীলা
অষ্টম শতাব্দীর শেষ ভাগে, পাল বংশের মহামান্য রাজা ধর্মপাল (৭৭০–৮১০ খ্রিঃ) বৌদ্ধ ধর্ম ও শিক্ষার প্রসারের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি এটি ছিল ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র।
ধর্মপাল চেয়েছিলেন এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে, যা শুধু বৌদ্ধ দর্শনের পাঠদান নয়, বরং চিন্তা, যুক্তি ও মানবিকতার বিকাশ ঘটাবে। তাই গঙ্গার তীরে, ভাগলপুরের কাছে অল্প উঁচু টিলার উপর স্থাপিত হয়েছিল বিক্রমশীলা মহাবিহার — জ্ঞানের এক অনন্য তীর্থস্থান।
📚 শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে বিক্রমশীলা
বিক্রমশীলা মহাবিহারে প্রায় ১০৭টি শিক্ষালয় ও বহু গ্রন্থাগার ছিল। এখানে পড়ানো হতো দর্শন, ব্যাকরণ, যুক্তিবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা, ও বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্ব।
এখানে প্রায় ১০৮ জন অধ্যাপক ও প্রায় ১,০০০ ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করতেন। শিক্ষার মাধ্যম ছিল সংস্কৃত ও পালি ভাষা। গুরু-শিষ্যের নিবিড় সম্পর্কের মাধ্যমে জ্ঞান বিতরণের যে ঐতিহ্য ভারতবর্ষে গড়ে উঠেছিল, বিক্রমশীলা ছিল তারই জীবন্ত প্রতীক।
বিশ্বখ্যাত পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, যিনি পরে তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন, তিনিও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন।
🏯 স্থাপত্যের সৌন্দর্য ও নিদর্শন
আজকের দিনে বিক্রমশীলার যা অবশিষ্ট রয়েছে, তা মূলত ধ্বংসাবশেষ, কিন্তু প্রতিটি ইট যেন এখনো প্রাচীন সভ্যতার গল্প বলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একটি বৃহৎ স্তূপ (Stupa) — বৃত্তাকার ও বহুস্তরবিশিষ্ট, যার চারদিকে ছয়টি মন্দির ও শিক্ষালয় স্থাপিত ছিল। এর পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়েছিল, যেন এটি বৌদ্ধ ধর্মের “ধ্যানচক্র”-এর প্রতীক হয়।
চারদিকে গৃহাকৃতি কক্ষ, প্রবেশদ্বার, প্রার্থনাস্থল, পাঠাগার ও ছাত্রাবাসের নিদর্শন আজও দেখা যায়। খননকার্যে পাওয়া অনেক নিদর্শন, যেমন—মূর্তি, তাম্রলিপি, পোড়ামাটির পাত্র, আজ সংরক্ষিত রয়েছে পাতনা মিউজিয়াম-এ।
⚔️ পতনের ইতিহাস
দুঃখজনকভাবে, দ্বাদশ শতকের শেষ দিকে তুর্কি আক্রমণের সময় বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। গ্রন্থাগারে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, শত শত পণ্ডিত ও ছাত্রকে হত্যা করা হয়। সেই থেকেই বিক্রমশীলা ইতিহাসের অন্তরালে হারিয়ে যায়, যতদিন না ২০শ শতাব্দীতে এর ধ্বংসাবশেষ পুনরায় আবিষ্কৃত হয়।
🌿 বর্তমান বিক্রমশীলা
আজ বিক্রমশীলা ধ্বংসাবশেষ আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (ASI)-এর তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত। সুসজ্জিত উদ্যান, পথবাতি ও তথ্যফলক পর্যটকদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
প্রতিবছর হাজার হাজার ইতিহাসপ্রেমী, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও পর্যটক এখানে আসেন। সূর্যাস্তের সময় প্রাচীন স্তূপের চারপাশে দাঁড়িয়ে যখন গঙ্গার হাওয়া বইতে থাকে, তখন মনে হয় যেন সেই পুরনো প্রার্থনার ধ্বনি এখনো ভেসে আসে — “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি”।
🧭 যাত্রাপথ ও ভ্রমণ পরামর্শ
- অবস্থান: ভাগলপুর জেলার অন্তর্গত অণ্টিচক গ্রামে, গঙ্গার দক্ষিণ তীরে।
- কীভাবে পৌঁছাবেন:
- নিকটবর্তী রেলস্টেশন — কাশিমবাজার বা ভাগলপুর জংশন (প্রায় ৫০ কিমি দূরত্বে)।
- রেলস্টেশন থেকে ট্যাক্সি বা গাড়িতে বিক্রমশীলা পৌঁছানো যায় প্রায় দেড় ঘণ্টায়।
- পাটনা থেকেও সরাসরি সড়কপথে যাত্রা সম্ভব (প্রায় ২২০ কিমি)।
- সেরা ভ্রমণ সময়: অক্টোবর থেকে মার্চ মাস।
🌸 উপসংহার
বিক্রমশীলা শুধু একটি প্রাচীন শিক্ষালয় নয়, এটি ভারতীয় বৌদ্ধ দর্শনের হৃদয়, জ্ঞানের মন্দির এবং সংস্কৃতির এক গৌরবগাথা। এখানে এসে মনে হয়, মানবসভ্যতার সত্যিকার শক্তি অস্ত্র নয়, জ্ঞান ও চিন্তায় নিহিত।
আজও বিক্রমশীলার ধ্বংসপ্রাপ্ত স্তূপের নীরবতা যেন ফিসফিস করে বলে —
“যে জাতি জ্ঞানকে শ্রদ্ধা করে, সে কখনো মুছে যায় না।”
✨
বিক্রমশীলা — যেখানে ইট-পাথরের ভেতর ঘুমিয়ে আছে ভারতের হারানো জ্ঞানের মহাকাব্য। 📖🌅












Leave a Reply