ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রূপসী রাজ্য আসামের এক অপরূপ শহর হলো জোরহাট (Jorhat)। সবুজে মোড়া চা-বাগান, ব্রহ্মপুত্রের নিকটতা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং প্রকৃতির শান্ত সৌন্দর্য — সব মিলিয়ে জোরহাটকে বলা হয় “আসামের সাংস্কৃতিক রাজধানী”। ইতিহাস, প্রকৃতি, শিল্প ও মানুষের সহজ সরলতা এখানে এমনভাবে মিশে গেছে যে, এই শহরে আসলে মনে হয় সময় একটু ধীরে চলে।
🌸 জোরহাটের ইতিহাস ও নামের উৎপত্তি
‘জোরহাট’ শব্দটি এসেছে আসামিয়া শব্দ ‘জোর’ অর্থাৎ দুই এবং ‘হাট’ অর্থাৎ বাজার থেকে। প্রাচীনকালে এখানে ছিল দুটি বড় বাজার — ‘চৌকিহাট’ ও ‘মাছারিহাট’। সেই থেকেই নাম হয় ‘জোরহাট’। ১৮শ শতকের শেষ দিকে আহোম সাম্রাজ্যের শেষ রাজধানী ছিল এই শহর। তাই ইতিহাসের পাতায়ও জোরহাটের বিশেষ স্থান রয়েছে।
🍃 চা-বাগানের শহর
জোরহাট মানেই চায়ের সুবাসে ভরা সবুজ পাহাড়ি উপত্যকা। এখানেই রয়েছে ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী চা-বাগানগুলির একটি — সি-চাগুয়া চা এস্টেট। ১৮৫০ সালের দিকে ব্রিটিশরা প্রথম এই অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে। আজও এখানে শত শত চা-বাগান ছড়িয়ে আছে।
জোরহাটে রয়েছে Tocklai Tea Research Institute, যা বিশ্বের প্রাচীনতম চা গবেষণা কেন্দ্র। চা উৎপাদনের মানোন্নয়ন, নতুন প্রজাতির চা-পাতা উদ্ভাবন, এবং বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় চা প্রক্রিয়াকরণে এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত।
🛕 ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মিলনভূমি
জোরহাট আসামের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত। এখানেই জন্মেছেন বহু শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংগীতজ্ঞ। “থাংখারিয়া নাট্যগৃহ”, “শ্রীমন্ত শংকরদেব কলাক্ষেত্র”, এবং “জোরহাট থিয়েটার” — এই শহরের শিল্পচর্চার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
এছাড়াও এখানে প্রতিবছর উদযাপিত হয় বিখ্যাত রঙালি বিহু উৎসব, যেখানে নাচ, গান, ঢোল ও পিপার আওয়াজে মুখর হয়ে ওঠে গোটা শহর।
🪷 দর্শনীয় স্থানসমূহ
জোরহাটে ভ্রমণ মানে প্রকৃতি ও ইতিহাসের মিলিত যাত্রা। এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান হলঃ
- মাজুলি দ্বীপ: জোরহাট থেকে ফেরিতে করে পৌঁছানো যায় বিশ্বের বৃহত্তম নদী দ্বীপে। বৈষ্ণব সংস্কৃতি ও মৃৎশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ।
- থেংখারিয়া বর নামঘর: শ্রীমন্ত শংকরদেবের অনুসারীদের এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মস্থান।
- সুয়ালকুচি গ্রাম: আসামের ঐতিহ্যবাহী রেশম শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ।
- গিবন অভয়ারণ্য (Gibbon Wildlife Sanctuary): ভারতের একমাত্র অভয়ারণ্য যেখানে হুলক গিবন প্রজাতির বাঁদরদের রক্ষা করা হয়।
- জোরহাট প্ল্যানেটেরিয়াম: জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রেমীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান।
🌿 প্রকৃতি ও জলবায়ু
জোরহাটের জলবায়ু নরম ও মনোরম। বছরের প্রায় সময়ই সবুজ চাদরে মোড়া থাকে চারপাশ। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রির কাছাকাছি থাকে, আর শীতে হালকা ঠান্ডা আবহাওয়া ভ্রমণের জন্য আদর্শ। বর্ষায় চা-বাগানগুলো ভিজে সবুজে আরও ঝলমলে হয়ে ওঠে।
🛣️ কীভাবে পৌঁছাবেন
- বিমানপথে: জোরহাট বিমানবন্দর (Rowriah Airport) শহর থেকেই ৭ কিমি দূরে অবস্থিত। গुवাহাটি, কলকাতা ও দিল্লি থেকে নিয়মিত বিমান পরিষেবা রয়েছে।
- রেলপথে: জোরহাট টাউন রেলওয়ে স্টেশন আসামের প্রধান লাইনে অবস্থিত।
- সড়কপথে: গुवাহাটি থেকে প্রায় ৩০০ কিমি দূরে, NH-37 ধরে সুন্দর সড়কপথে বাস বা গাড়িতে সহজে পৌঁছানো যায়।
🏨 কোথায় থাকবেন
জোরহাটে রয়েছে বিভিন্ন মানের হোটেল, রিসোর্ট ও গেস্ট হাউস। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হলো —
- Hotel Heritage Jorhat
- Hotel MD’s Continental
- Banyan Grove Tea Estate Resort
- Kaziranga Golf Resort (একটি চা-বাগানের মধ্যে বিলাসবহুল রিসোর্ট)
💫 উপসংহার
জোরহাট এমন এক শহর যেখানে প্রকৃতির ছোঁয়া, ঐতিহ্যের গর্ব ও মানুষের আন্তরিকতা একসাথে মিশে যায়। ব্রহ্মপুত্রের শান্ত স্রোত, চা-বাগানের সবুজ ঢেউ, নামঘরের ঘণ্টাধ্বনি — সব মিলিয়ে জোরহাট ভ্রমণ মানেই আত্মাকে ছুঁয়ে যাওয়া এক অভিজ্ঞতা।
✨ “জোরহাটের চায়ের সুবাস শুধু পাতা থেকে নয়, মিশে থাকে তার মানুষের হাসিতেও।” ✨












Leave a Reply