ওপার বাংলার কিংবদন্তী টেবিল টেনিস খেলোয়ার, প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ও কম্পোজার এবং স্বনামধন্য চিকিৎসক ডাঃ মানস চৌধুরী ( রঞ্জন) এর একান্ত সাক্ষাৎকার…!

0
189

বাংলাদেশের স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধকালিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বলিষ্ঠ কন্ঠ শিল্পী, বাবা প্রবাল চৌধুরীর হাত ধরে সঙ্গীতের যাদুতে মুগ্ধ হয়ে ডুবে থাকা কিশোর ছেলেটি হঠাৎ একদিন ১২ বছর বয়সে কাকু স্বপন চৌধুরীর দেয়া পুরোনো টেবিল টেনিস ব্যাট হাতে নিয়ে তন্ময় হয়ে ডুবে গেলেন সাদা পিংপং বলের যাদুকরী ক্রীড়া শৈলীতে…!
গায়ে ১০২° জ্বর নিয়ে ২০০১ সালে প্রথম ন্যাশনাল ফাইনালে খেলতে শুরু করা মানস চৌধুরী পরপর চারবার সহ মোট পাঁচবার বাংলাদেশের জাতীয় টেবিল টেনিসে চ্যাম্পিয়ন এবং শেষ ১০ টি ন্যাশনাল ফাইনালে অংশ নিয়ে, ৪৩ বছর বয়সেও পিংপং এর কিংবদন্তি খেলোয়াড় হিসেবে আজও ধরে রেখেছেন তার শীর্ষ অবস্থান..!
একজন ক্রীড়াবীদ “মানস চৌধুরীর” জীবনের গল্পটা রুপথার নায়কের মতোই বর্ণাঢ্য হয়ে উঠে, যখন তার পেশাগত জীবনে দেশের একজন সফলতম চিকিৎসক হয়েও বাংলাদেশের ক্রীড়া জগতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র মানুষটি তার বাবার স্বপ্নের পূর্নতা দিয়ে নিজের সঙ্গীত জীবনের পথচলা শুরু করেন সিনেমায় প্লে ব্যাকের মাধ্যমে রঞ্জন চৌধুরী নামে…!
নিজেকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠের কাতারে নিয়ে যাওয়া সদাহাস্যজ্বল প্রানবন্ত চমৎকার এই কিংবদন্তি মানুষটির একান্ত কিছু কথা জানতে কিংবদন্তি মানস চৌধুরীর সাথে মুখোমুখি আলাপনে সব খবর পক্ষ থেকে সাহিত্যিক সৌগত রাণা কবিয়াল…!
সবখবর সারাদিন–
আপনাকে সব খবর, সব খবর সারাদিন ও ডেইলি হান্ট পরিবারের পক্ষ থেকে স্বাগতম..! কেমন আছেন..?
ডাঃ মানস চৌধুরী ( রঞ্জন ) –
ধন্যবাদ.. খুব ভালো আছি..!
সবখবর সারাদিন––
প্রথমেই জানতে চাইবো একজন সফল ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার গল্পটা..?
ডাঃ মানস চৌধুরী ( রঞ্জন ) –
আমার কাছে আসলে সফলতা অর্জনটা ঠিক প্রচলিত ধারায় অর্থবহ নয়..! আমি মনে করি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা যা ভালোবাসি সেটাকে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ..! নিজের ভেতরের মানুষটার সাথে সঠিক বোঝাপড়াটাই একজন মানুষের জীবনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ..! সময়ের প্রতিটি মুহুর্তকে উপভোগ করতে জানলে যে কোন মানুষ তার নিদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে.. তবে সেটা যেন কখনোই শুধুই প্রতিযোগিতা মূলক না হয়..! আমি নিজে আমার ভালোলাগার ব্যাপারগুলোতে নিজেকে গড়তে ভালোবাসি, অনেকটা নিজের সাথে নিজের খেলার মত.. এখানে হারজিৎ টা মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে আমি নিজে কতোটা উপভোগ করছি আমার কাজটাকে…!
সবখবর সারাদিন– –
অসাধারণ..!
ক্রীড়াবিদ হিসেবে একজন সফল ‘মানস চৌধুরী’ আপনার চোখে দেখতে কেমন ?
ডাঃ মানস চৌধুরী ( রঞ্জন ) –
দেখুন, নিজেকে সফল দেখতে সব মানুষেরই ভালো লাগে, সে ক্ষেত্রে আমিও তার ব্যতিক্রম নই..! তবে আপনি যখন ধীরেধীরে আপনার নিজস্ব অবস্থানে সফল হয়ে উঠবেন, তখন পেছনে ফিরে তাকালে আপনি নিজের প্রতিভাকে স্পষ্ট চিনতে পারবেন, আর সামনে তাকালে আপনি নিজেকে আরও নতুন ভাবে দেখার আনন্দ পেতে চাইবেন..! আমি কখনোই আমার কোন সফল সমাপ্তির পর নিজেকে থামিয়ে দিতে চাই না.. একটা সফল সময়ের পর আমি পরবর্তী সময়ের কথা ভাবি…! জীবনের যেকোন প্রাপ্তিই আনন্দের, তবে আমার কাছে আমার প্রতিটি সফল প্রাপ্তি আমাকে পরবর্তী সময়ের জন্য আরও বেশি ক্ষুধার্ত করে তোলে..! আমি এগিয়ে যাওয়াতে বিশ্বাস করি এবং অবশ্যই সেটাকে আনন্দের সাথে উপভোগ্য সুখ হিসেবে সঙ্গী করে…!
সবখবর সারাদিন–-ঃ
আপনার দীর্ঘ ২৫ বছরের খেলোয়াড় জীবনে কথা জানতে চাই আপনার ভাবনায়..?
ডাঃ মানস চৌধুরী ( রঞ্জন ) –
পেশাগত জীবনে আমি একজন চিকিৎসক..! টেবিল টেনিসে আমার হাতেখড়ি মূলত আমার কাকু স্বপন চৌধুরীর অনুপ্রেরণায়..! যদিও ছেলেবেলা থেকেই আমাদের পরিবারে সাংস্কৃতিক চর্চাটাই বেশী ছিলো..! আমার কৈশোরে কাকু একদিন তার পুরোনো একটি ব্যাট উপহার দিয়েছিলেন আমায়..! তারপর, কৈশোরে যা হয় আরকি, সেই বয়সে নতুন কিছু জানা বা শেখার আগ্রহ থাকে মনে, সেই থেকে টেবিল টেনিস ব্যাট হাতে পিংপং বলের সাথে বোঝাপড়ার খেলাটা ভালো লাগতে শুরু..! চট্রগ্রামে আমার বাড়ির পাশের অগ্রণী সংঘ ক্লাবে, আমার কাকু স্বপন চৌধুরী সেখানে অন্যান্য প্যাডেলারদের সাথে অনুশীলন করতেন, আমিও একসময় সেখানে খেলতে শুরু করি..! সেই সময় রূপম দত্ত এবং ডাঃ অরূপ দত্ত নামে দুই ভাই (স্থানীয় চ্যাম্পিয়ন ) আমার খেলা দেখে একদিন উনাদের নবীন মেলা ক্লাবে আমাকে খেলার সুযোগ করে দেন, মূলত সেখান থেকেই টেবিল টেনিসে আমার ক্যারিয়ার শুরু হয়..! সেই ভাবে বলতে গেলে রূপম দত্ত ছিলেন আমার প্রথম প্রশিক্ষক..!
আমার ২৫ বছরে খেলোয়াড় জীবনের ক্যারিয়ারে-
আমি ৮৯ সালে ১৩ বছর বয়সে বাটা স্কুল প্রতিযোগিতায় প্রথম অংশগ্রহণ করি, ৮৮ সালে জাতীয় স্কুল টেবিল টেনিস প্রতিযোগাতা প্রথম অবস্থান । তারপর, আমি ১৯৯০ সালে আমার প্রথম জুনিয়র জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ খেলে ১৪ তম স্থানে আসি, পরের বছরই আমি জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম শিরোপা অর্জন করি । ১৯৯২ সালে নয়াদিল্লিতে এশিয়ান টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপের বাংলাদেশ দলের সদস্য হওয়ার প্রথম সুযোগ পাই, এটি আমার প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার পাশাপাশি প্রথম বিদেশ সফরও ছিল ! তারপর থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত টানা খেলি । এই সময়ে আমি প্রায় সমস্ত জুনিয়র প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, এবং ১৯৯৮ সালে সার্ক-আসিয়ান টেবিল টেনিস টুর্নামেন্ট এবং ২০০১ সালে আমি প্রথম যৌথ জাতীয় সিনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ খেলি, সেবার( ১৯৯৮) আমরা ব্রোঞ্জ জিতেছিলাম সার্ক-আসিয়ান টুর্নামেন্টে…! তখন নিজের মেডিকেল পড়াশোনা শেষ করতে আমি ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত টানা ছয় বছর টেবিল টেনিসের বাইরে ছিলাম ! তারপর ২০০৭ সালে আবার থেকে পুনরায় শুরু করে আমি ২০০৯, ২০১১, ২০১২, ২০১৪, ২০১৫ সালে পাঁচবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হই এবং ২০০১, ২০১০, ২০১৬ এবং ২০১৯ সালে চারবার রানার্সআপ হই..!
সার্ক-আসিয়ান টুর্নামেন্টের পরে, আমরা দেশের হয়ে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে ২০১০ সালে তিনটি ব্রোঞ্জ পাই । তারপরে, আমি কমনওয়েলথ গেমস ২০১৪ সালে পুরুষ একক শীর্ষে (প্রাক-কোয়ার্টার) ফাইনাল খেলি, এগুলো ছাড়াও আমি ২০০০ এবং ২০১৯ সালে দুটি কমনওয়েলথ টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে, ২০০৯, ২০১৫ এবং ২০১৯ সালে তিনটি এশিয়ান টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছি ; চারটি বিশ্ব টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১১ সালে (একক ও ডাবলস বিভাগ), ২০১৩ সালে (একক ও দ্বৈত বিভাগ), ২০১৪ সালে (দল বিভাগ) এবং ২০১৫ সালে (একক ও ডাবলস বিভাগ) !
আমি এখন পর্যন্ত চট্রগ্রাম থেকে প্রথম ও একমাত্র জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া খেলোয়ার !
এক যুগ ধরে শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছি…! ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রথম আটে সব সবসময় থেকেছি, শেষ দশটা ন্যাশনাল ফাইনালের নটাতেই খেলেছি আমি..এখনো নিয়মিত
লিগ খেলছি..! ২০১০ সাল থেকে টিমকে লিড দিয়ে চ্যম্পিয়ন করেছি এবং বর্তমানে শেখ রাসেল ক্লাবের হয়ে খেলছি..!
সবখবর সারাদিন– –
সত্যি বিষ্ময়কর আপনার ক্রীড়া জীবন..!
আপনার কি মনে হয়, জাতীয় পর্যায় থেকে জেলা, স্কুল স্তরের নানা টুর্নামেন্টের এই ইভেন্টগুলোতে খেলে, স্কুল টুর্নামেন্টের গন্ডি পেড়িয়ে মেধাবী খেলোয়াড়রা কি সঠিক মূল্যায়ন নিয়ে শেষপর্যন্ত শীর্ষ প্রতিযোগিতায় পৌঁছাতে পারে ? আমরা জানি এক্ষেত্রে আপনি বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে যুগান্তকারী একটি লড়াই করেছেন এবং আইনি ভাবে বিজয়ী হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খেলোয়াড়দের জন্য একটি বড় সামাজিক-রাজনৈতিক বাধা দূর করেছেন..! সে ব্যাপারেও কিছু শুনতে চাইছি..?
ডাঃ মানস চৌধুরী ( রঞ্জন ) –
দেখুন, আমার মতে একজন স্পোর্টস ম্যানের সবচাইতে বড় সাধনা হচ্ছে তার নিয়মানুবর্তিতা ও প্রচেষ্টা..! সেই ক্ষেত্রে একজন খেলোয়ারকে তার খেলাটাকেই ভালোবেসে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে নিজেকে..! একটা অর্জনের সীমান্তে পৌঁছাতে বাঁধা বিপত্তি থাকবেই, কিন্তু, সব পরিস্থিতিতে নিজের মনোবল ধরে রেখে পরিশ্রম করে যাওয়াটাই হচ্ছে আসল কাজ…! চেষ্টার ফল অবশ্যই মিষ্টি হয়….!
হ্যাঁ, আমার খেলোয়াড়ি জীবনে এমন একটা মুহুর্ত এসেছিলো যে তখন আমার মনে হয়েছিলো ‘এই যায়গা থেকে একটা স্থায়ী সমাধান হয়তো আগামী প্রজন্মের খেলোয়াড়দের জন্য খেলাকে পেশা হিসেবে নেয়ার যুদ্ধটা কিছুটা হলেও সহজ হবে’..!
একটা সমস্যা একসময় ছিল, কিন্তু এখন তা সমাধান হয়ে গেছে…! একবার বিটিটিএফ এসএ গেমসের আগে একটি প্রশিক্ষণ শিবির শুরু হয়, আমার ব্যাক্তিগত পেশাগত সমস্যার কারণে আমি সেই সময় অনুশীলন ক্যাম্পে যোগ দিতে পারিনি ! সুতরাং, র‌্যাঙ্কিং এর শীর্ষে থাকা অবস্থায়ও তৎকালীন কতৃপক্ষ আমাকে ক্যাম্প থেকে বাদ দিয়ে দেন, এমনকি তারা আমাকে সেই সময় বাছাইপর্বে খেলতেও দেয়নি । বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ) প্রদত্ত নিয়ম অনুসারে, কোনও ক্রীড়াবিদ শিবিরে অংশ না নিলে তিনি অনুমতি পাবেন না। এমতাবস্থায় কেবল ফেডারেশনই তাকে তার নিজের ঝুঁকিতে খেলতে দিতে পারে। একজন চিকিৎসক হিসাবে আমার পেশার কারণে আমি কখনই শিবিরে যোগ দিতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে আমার টপ র‌্যাঙ্কিং এর একজন খেলোয়ার হিসেবে ফেডারেশনের ফেবারটা প্রাপ্য ছিলো..। আমি তখন জাতীয় র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে ছিলাম এবং গেমসের আগে কমনওয়েলথ এবং এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ নামে দুটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টও খেলেছিলাম । আমি তাদের অনেকবার অনুরোধ করি, তবে আমাকে খেলতে না দেয়ায় তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল..! তারপরে, আমি হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করি এবং আমার দীর্ঘ একক যুদ্ধের পর মাননীয় আদালত আমার পক্ষে রায় দেন । এই রায়ের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কোন শীর্ষ র‌্যাঙ্কিং অ্যাথলেটদের বাছাইপর্বে অংশ নিতে আর কোন সীমাবদ্ধতা থাকবে না..!
এতে আগামীতে অন্তত কোন খেলোয়াড়কে তার পেশাগত জীবিকার জন্য তার প্রিয় খেলাকে ছাড়তে হবে না..! আমার মনে হয়, হাতে গোনা দুই একটা খেলা ছাড়া আমরা যেহেতু অন্য খেলাগুলোতে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ব্যাবস্থাপণা করতে সীমাবদ্ধ, তাই খেলোয়াড়দের মেধা বিকাশে তাদের পেশাগত জীবিকাকে মূল্যায়ন করলে, দেশ জাতিগত ভাবে আন্তর্জাতিক স্তরে ক্রীড়াঙ্গনে আরও বেশি সাফল্য ও মর্যাদা অর্জন করবে..! আর কোন ধরনের জাতীয় মর্যাদাই ব্যক্তি সাফল্য ছাড়া স্বম্ভব হয় না..!
সবখবর সারাদিন–-
বাংলাদেশের টেবিল টেনিস খেলার ইতিহাস নিয়ে কিছু বলবেন..?
ডাঃ মানস চৌধুরী ( রঞ্জন ) –
১৮৮০ সালে ইংল্যান্ডে উৎপত্তি হয়ে ১৯৮৮ সালে সিউল অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকেই ইনডোর গেম হিসেবে ‘টেবিল টেনিস’ এশিয়া তথা ভারত ও বাংলাদেশে স্কুল পর্যায়ে জনপ্রিয় একটি খেলা, যদিও বিশ্বের অধিকাংশ সেরা টেবিল টেনিস খেলোয়াড় চীন দেশের জন্মগ্রহণকারী। অন্যদিকে, ইউরোপীয় দেশের মধ্যে জার্মানি অন্যতম। ১৯২৬ সালে আইটিটিএফ টেবিল টেনিসের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মূলত বাংলাদেশে ৫০ এর দশক থেকে টেবিল টেনিস তথা পিংপং খেলাটি শুরু হলেও সামগ্রিকভাবে জনপ্রিয় খেলা হিসেবে সুপরিচিত না হলেও, আমাদের দেশের স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এ খেলা ইনডোর গেম হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাংলাদেশে ফুটবল ও ক্রিকেটের পরই সর্বাধিকসংখ্যক জেলা দল টেবিল টেনিস জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে..!
ফেডারেশনের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ, মহানগরী প্রিমিয়ার ডিভিশন, প্রথম ডিভিশন ও মহিলা ডিভিশনের ক্লাব লীগ, জাতীয় স্কুল প্রতিযোগিতা, বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতা, আমন্ত্রণমূলক প্রতিযোগিতা, কয়েকটি প্রাইজ মানি প্রতিযোগিতা প্রভৃতি…! ফেডারেশন ছাড়াও কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন ব্যাপক আকারের টেবিল টেনিস টুর্নামেন্ট আয়োজন করে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, স্বামীবাগ টেবিল টেনিস সংস্থা এবং ঢাকা ক্লাব বড় ধরনের টেবিল টেনিস টুর্নামেন্ট আয়োজন করে থাকে…!
টেবিল টেনিসে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে বেশ সাফল্যও অর্জন করেছে। ১৯৯৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম সার্ক ও আসিয়ান দেশসমূহের ১২টি দেশের মধ্যে জুনিয়র প্রতিযোগিতায় বালক দলগত বিভাগে তৃতীয় স্থান অধিকার করে। ১৯৯৩, ১৯৯৫ ও ১৯৯৭ সালের সাফ গেমসে পুরুষ দলগত বিভাগে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করে। ১৯৮৩ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান জুনিয়র্স চ্যাম্পিয়নশিপে একক বিভাগে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলে। ১৯৯৭ সালে সাফ গেমস পুরুষ একক বিভাগে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করে। এছাড়া ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সাফল্যের সঙ্গে টেবিল টেনিস এশিয়া কাপ টুর্নামেন্টের আয়োজন করে…!
সবখবর সারাদিন–
দীর্ঘদিন বাংলাদেশ জাতীয় টেবিল টেনিসে নিজের অবস্থানের অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খেলোয়াড়দের প্রতি
আপনার নির্দেশনা ?
ডাঃ মানস চৌধুরী ( রঞ্জন ) –
আসলে আমাদের দেশে নিদ্দিষ্ট একটি-দুটি গেম ছাড়া অন্য কোন গেম নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্রেজ লক্ষনীয়ভাবে প্রকাশ পায় না..! এটা আসলে আমাদের পরিকল্পনাগত, পরিকাঠামোগত এবং বানিজ্যিক সমস্যা থেকে হয়..! দেশের জাতীয় ক্রীড়া কর্তৃপক্ষ হয়তো জনপ্রিয়তা ও বানিজ্যিক মানদন্ডে বিচার করে এই গেমটির বিষয়ে খুব একটা বেশি চিন্তা করে না, এক্ষেত্রে প্যাডেলাররা বা আয়োজকরাও তা করেন না । ভারতে, একজন পেশাদার প্যাডলার তার ফেডারেশন বা ক্লাবগুলির কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পান। তিনি সরকারী চাকরী পেতে পারেন এবং তার ট্যুরের জন্য স্পনসরশিপ পেয়ে থাকেন, তবে আমাদের দেশে এই সুযোগগুলি সীমিত । আমরা আর্থিক সহায়তা পাই না, চাকরি এবং স্পনসরশিপ পাই না। সুতরাং, আমরা কীভাবে এখানে আরও উন্নত ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পারি ? আমাদের বেশিরভাগ সংগঠকও উপযুক্ত অভিজ্ঞতার অভাবে অদক্ষ । অব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক অনিশ্চয়তা তো রয়েছেই । সুতরাং, আমাদের এই গেমটির পুরো অবকাঠামো পুনর্গঠন করা দরকার। এক্ষেত্রে আমাদের সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ, পর্যায়ক্রমিক ভাবে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তারা এই গেমটির উন্নতির জন্য কিছু দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারে। তবে সবার আগে, তাদের আমাদের প্যাডেলারদের জন্য আর্থিক নিশ্চয়তা এবং কাজের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সরকার বেসরকারী সংস্থা, বিশেষত ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক সংস্থাগুলিকে টেবিল টেনিস খেলোয়াড়দের সমর্থন করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এছাড়াও তারা স্বতন্ত্র কমিটির অধীনে তরুণ প্যাডেলারদের জন্য কিছু প্রতিভা অনুসন্ধান এবং আবাসিক প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করতে পারে।
খেলোয়াড়দেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। তাদের অবশ্যই যোগ্যতা প্রমাণ করতে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং একটি ন্যূনতম শিক্ষাগত পটভূমির অধিকারী হতে হবে। একজন সিনিয়র প্যাডলার হিসাবে, আমি দেশের জুনিয়র প্যাডেলারদের শিক্ষিত এবং কঠোর পরিশ্রমী হওয়ার পরামর্শ দেবো, যাতে তারা এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধাগুলো সহজে কাটিয়ে উঠতে পারে । আমি বিটিটিএফ এবং অন্যান্য আয়োজকদেরও তরুণ প্যাডেলারদের অনুপ্রাণিত ও পরিচর্চা করার জন্য অনুরোধ করব। আমি বিশ্বাস করি যে আমরা যদি এক সাথে কাজ করি তবে আমরা টেবিল টেনিসের স্কুল পর্যায়ের যে লোকপ্রিয়তা তা পরবর্তীতে বৃহত্তর ক্ষেত্রে ধরে রাখতে পারবো..!
সবখবর সারাদিন–-
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। একজন ব্যাক্তি মানস চৌধুরীর সমান তালে গায়ক রঞ্জন চৌধুরী হয়ে উঠার পেছনের গল্পটা জানতে চাইছি ?
ডাঃ মানস চৌধুরী ( রঞ্জন ) –
সঙ্গীত আসলে সবসময় আমাদের জীবন আবেগের অনেক বড় একটি যায়গা জুড়ে..! আমি আমার পরিবার থেকে এই আবেগ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি ! আমার বাবা প্রবাল চৌধুরী (মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের খ্যাতিসম্পন্ন সংগীতশিল্পী) একজন বিখ্যাত প্লেব্যাক গায়ক এবং সুরকার ছিলেন। উনার নামে চট্রগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণও হয়েছে..! উনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত শিল্পী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অনুপ্রেরণামূলক মুক্তির গানের একজন সদস্য ছিলেন..! আমার গানের হাতেখড়িটা বাবার হাত ধরেই…!
আমার কাছে চারটি একক অ্যালবাম সহ ২৭ টি সংগীত অ্যালবাম রয়েছে। আমার প্রথম অ্যালবামটি ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল I
বাবা প্রবাল চৌধুরীর হাত ধরে ছেলেবেলা থেকেই দেশ বিদেশের কিংবদন্তি সঙ্গীত ব্যাক্তিত্বের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল..তাছাড়া জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী উমা খান ও কল্যাণী ঘোষ আমার পিসি। এমন একটি সঙ্গীত পরিবারে জন্ম নিয়ে তাই গানটাকে ছেলেবেলা থেকেই ভালোবাসতাম..! গানের জগতে অবশ্য আমি রঞ্জন চৌধুরী নামে পরিচিত। সঙ্গীতা মিউজিক কোম্পানির কর্ণধার সেলিম খান আমার ডাক নামটা ( রঞ্জন ) পছন্দ করে অ্যালবামে ( হলে না জীবন সাথী) জুড়ে দেন।
এ পর্যন্ত আমার একক অ্যালবাম বেরিয়েছে চারটি, মিশ্র ও দ্বৈত অ্যালবাম সব মিলে সাতাশটি। এছাড়া প্রায় ত্রিশটি সিনেমায় গান প্লে ব্যাক করেছি । গীতিকার কবির বকুলের লেখা প্রথম গানটি ছিল, ‘ভালোবাসা বড় কষ্ট রে ‘…গানটির সুরকার ছিলেন আলাউদ্দিন আলী..! আমি বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিশেষ গ্রেডের একজন তালিকাভুক্ত সঙ্গীত শিল্পী…! আমি নিজের ভালো লাগার যায়গা থেকে বেশ কিছু গানে সুর ও কম্পোজিশন করেছি এবং এখনও করছি..!আমার এই কম্পোজিশনগুলোতে আমি ছাড়াও কন্ঠ দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী
.! সঙ্গীতা কোম্পানি থেকে প্রকাশিত আমার
প্রথম এলব্যামটি তখন বেষ্ট সেলিং এ দ্বিতীয় অবস্থান অর্জন করেছিলো..! জাতীয় স্তরে সঙ্গীতে পুরুস্কারের জন্য একাধিকবার মনোনীত হয়েছি..! ২০০০ সাল থেকে প্রফেশনাল গান গাওয়া শুরু করি..!
সব চাইতে বড় কথা হলো, আমি ছেলেবেলা থেকেই যা করতাম, আনন্দের সাথে করতাম..! তাই কোন কিছুতে প্রাপ্তির আশা না করে উপভোগ করতাম নিজের কাজ ও সময়কে..!
সবখবর সারাদিন–-
নিজের পেশাগত জীবনে একজন চিকিৎসক হিসেবেও আপনি সমানতালে সফল.. কিভাবে সামলান নিজের এই একাধিক সামাজিক পরিচয়..?
ডাঃ মানস চৌধুরী ( রঞ্জন ) –
আমি তো উপভোগই করি এই সবকিছুকেই..! ব্যাক্তিগত জীবনে আমি খুব ডিসিপ্লিনড..! এখনও প্রতিদিন দু ঘন্টা রেওয়াজ করি..! নিয়ম করে ব্যাট হাতে অনুশীলন করি..! সিটি ডেন্টাল কলেজ থেকে পাস করে একজন চিকিৎসক হওয়ার পর থেকেই আমি চেষ্টা করি নিজের পেশায় প্রচুর পড়াশোনা করার..! কারণ চিকিৎসা শাস্ত্র প্রতিনিয়ত সম্বৃদ্ধ হচ্ছে, তাই নিজেকেও আপডেট করে নেয়াটা জরুরি…! একজন চিকিৎসক হিসেবে চেষ্টা করি পেশাগত জীবিকার পাশাপাশি দায়বদ্ধতার যায়গা থেকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে…! আসলে সফলতা যখন আপনার সাথে জুড়ে যাবে, আমার মনে হয় তখন আপনার সমাজ ও নিজের মেধার প্রতি দায়বদ্ধতার যায়গাটাও বেড়ে যায়…!
সবখবর সারাদিন–-
এই যে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সত্তাতে আপনি নিজেকে মানিয়ে পথ চলেন, এর ফাঁকে অবসরে মানস চৌধুরী কেমন ?
ডাঃ মানস চৌধুরী (রঞ্জন)-
পারিবারিকভাবে আমার মা- মীরা চৌধুরী, সহধর্মিণী- তনিমা চৌধুরী, ছেলে – ইন্দ্রনীল ও মেয়ে ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে আমাদের চমৎকার আড্ডার অবসর কাটে
…! আমার দু-সন্তানই গান ভালোবাসে..! আমি রান্না করতে ভালোবাসি, তাই অবসরে এটা ওটাও করি..! প্রাণ খুলে বন্ধুদের সাথে রাতে চেম্বারের পর আড্ডা দিই…! একটাই তো জীবন.. বলুন.. তাই চেষ্টা করি ইশ্বরের আশির্বাদের এই জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে সুন্দর ও সৎ ভাবে বাঁচার..! এক কথায় বলতে পারেন, আমি আমার জীবনকে উৎযাপন করতে ভালোবাসি..হাহা….!
সবখবর সারাদিন–-
অসাধারণ…! আচ্ছা শেষ প্রশ্ন আপনার কাছে..! ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশেষ কিছু পরিকল্পনা..?
ডাঃ মানস চৌধুরী ( রঞ্জন )-
ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে বেশ কয়েকজনকে তৈরী করে যাবো নিজের মত করে, যাতে টেবিল টেনিসের জগতের নক্ষত্র হয়ে থাকতে পারে তারা..! আমার সুখের ব্যাপার হচ্ছে আমি যে সকল জুনিয়রদের ট্রেনিং দিচ্ছি তাদের মধ্যে একজন ( সজিব, সেও চট্রগ্রামের ছেলে ) জাতীয় পর্যায়ে এই মুহুর্তে তৃতীয় অবস্থানে আছে..! একজন শিক্ষকের কাছে তার ছাত্রকে নিজের মুখোমুখি প্রতিযোগী হিসেবে পাওয়াটা সৌভাগ্যের ব্যাপার…!
নিজের কোন এচ্যিভমেন্টের পর আমি সবসময় নেক্সটটা নিয়ে ভাবতে পছন্দ করি..! ভালোবাসি সময়ের সাথে চলতে..! ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেবিল টেনিস একাডেমি খোলার স্বপ্ন দেখি, যেটা অনেকটাই বাস্তবায়নের কাছাকাছি এসেছে সকলের সহযোগিতায়..!
সবখবর সারাদিন–-
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সব খবরকে আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য..! আপনার জন্য শুভকামনা রইলো..!
ডাঃ মানস চৌধুরী ( রঞ্জন ) –
সব খবর এবং সব খবর এর সম্মানিত পাঠকদের প্রতি আমার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও শুভকামনা…!
সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও সম্পাদনায়-
সৌগত রাণা কবিয়াল
( কবি সাহিত্যিক ও কলামিস্ট )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here