কানাই কাকা হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে । কাকাকে দেখা মাত্র কুহেলি পেছন ডেকে বলল, “কাকা ! তোমার সাথে একটা দরকারি কথা আছে !”
“হ্যাঁ মা । তুমি বলো, তোমার কথাটা শুনে যাই । আমাকে এখন সালার যেতে হবে । চাষের জমিতে কীট-পতঙ্গ মারবার জন্য ঔষধ আনতে হবে । তাই তাড়াহুড়ো ।” কানাই কুহেলির দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য বর্ণনা করলো ।
অন্যদিকে কাকীমা খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠলো, “দিলি তো পেছন ডেকে । তোর কথা বলার দরকার থাকলে আরও সকালে ঘরে এসে বলতে পারতিস । দেখছিস, হন্তদন্ত হয়ে লোকটা কাজে বেরিয়ে যাচ্ছে । ঠিক সেই সময় তাকে পেছন ডাকার দরকার হলো বেহায়া মেয়ে !”
কাকীমার দিকে তাকিয়ে কানাই কাকা বলল, “তুমি চুপ করো । দেখছো মেয়েটা কাঁচমাচু হয়ে কী যেনো বলতে এসেছে, নিশ্চয় খুব দরকার !”
“দরকার না ছাই ! দ্যাখো, টাকা চাওয়ার অছিলায় তোমাকে ডাকছে কিনা ? এই মেয়েকে দিয়ে বিশ্বাস নেই । এত করে তুমি বললে, মামা বাড়ি গিয়ে থাকতে । মেয়েটার সেদিকে হেলদোল নেই । উল্টে ঠ্যাটার মতো বাড়িতে রয়ে গেলো । এখন ঐ রাজরানীকে কে টাকা দেবে ?” এই কথা বলে কাকীমা কাকুর দিকে তাকিয়ে চোখ বড় করে বলল, “যদি কোনোদিন শুনি ঐ বেহায়া মেয়েকে লুকিয়ে টাকা দিয়েছো, তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না ।“
আহা গিন্নি ! ঘরে যাও । কুহেলি-মা, সেরকম মেয়ে নয় । কুহেলি মায়ের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ষোলোআনা !
কাকীমা কানাই কাকার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙ্চিয়ে বড় বড় চোখ করে স্থান ত্যাগ করলো । কিন্তু যাওয়ার সময় শারীরিক ভাষায় কানাই কাকাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো, কুহেলির কোনোরকম বায়না-আবদার শোনা যাবে না ।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো কুহেলির কানাই কাকা । তারপর কুহেলির দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি এনে জিজ্ঞাসা করলো, “বলো মা, কী বলবে ?”
বলছিলাম আমার করুণ জীবনের কথা । পয়সা-কড়ি শেষ ! ভাবছি, নিজের চেষ্টায় উপার্জনের কথা !
বেশ তো ! কীভাবে উপার্জনের কথা ভাবলে, আমাকে খুলে বলো ?
কাকা, আমি কাঞ্চন নগর গাঁয়ে ঢোকার মুখে চায়ের ভদোকান খুলতে ? তোমার কী মত ?
ভাল প্রস্তাব ! কিন্তু সেখানে লোহাদহের মুরারী ঘটকের চায়ের দোকান রয়েছে । মোড় দিয়ে লোকজনের যাতায়াত কম । সুতরাং একটা দোকান থাকা অবস্থায় তুমি দোকান খুললে বেচাকেনা কেমন হবে সেই ব্যাপারে আগেভাগে ভেবেচিন্তে এগোতে হবে । যাতে পরে পস্তাতে না হয় ?
কাকা, আমি এখন চা দিয়ে শুরু করতে চাই । পরবর্তী সময়ে দোকানে লাভের মুখ দেখলে, দোকানটির কলেবর বাড়াতে চাই ।
কেমন ধরনের ব্যবসার কথা বলছো ?
বলছি, চায়ের দোকান ভাল চললে আমি সেখানে মুড়ি, ঘুগনি, পাউরুটি, পাকা কলা, ইত্যাদি রাখতে চাই । যাতে সাধারণ মানুষ সকালে বিকালে আমার দোকান থেকে জল খাবার খেয়ে তাঁদের কাজে বের হতে পারেন ।
অতি উত্তম প্রস্তাব । দোকান খোলার ব্যাপারে আমার সায় আছে । তবে মা, খুব সাবধান ! দিনকাল ভাল নয় । এখনকার মানুষ আগের মতো উদার বা হিতাকাঙ্ক্ষী নয় । মানুষ সুযোগ খোঁজে “তিলকে তাল করার জন্য” । কেউ কারও ভাল দেখতে পারে না । সুতরাং তুমি যতোটা সহজে দোকান খোলার কথা ভাবছো, সেটা অতো সহজ ব্যাপার নয় । বাস্তব জগত বড় কঠিন ! সুতরাং যেটা করবে খুব সাবধানে করবে । তবেই আখেরে তোমার ব্যবসার উন্নতি ঘটবে । আমার সময় হয়ে গেছে, আমি এবার ভরতপুরের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছি ! সেখান থেকে বাসে আমার গন্তব্যস্থল, সালার । কানাই কাকা কুহেলির মাথায় হাত রেখে বলল, “ঈশ্বর তোমার মনোবাঞ্ছা পূরণ করুক !”
কাকা চলে যাওয়ার পর প্রমাদ গুণতে থাকলো সে কীভাবে চায়ের দোকান খুলবে ।
কুহেলি গভীরভাবে অনুধাবন করছে, তার পুরানো প্রেমিক শীতল ইদানীং তার খোঁজখবর রাখে না । লোক মুখে কুহেলি জানতে পেরেছে, “শীতলের বাড়ির মানুষের তীব্র আপত্তির জন্য কুহেলির সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ ।“ অথচ শীতল একদিন কথা দিয়েছিল, কুহেলির সমস্ত বিপদ-আপদে শীতল তার পাশে ঢাল হয়ে থাকবে । কলকাতায় পড়তে যাওয়ার পর থেকে শীতলের মানসিকতা্র পুরোপুরি বদল । কুহেলির সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ । ভরতপুরের এক বান্ধবীর মারফত কুহেলি আরও জেনেছে, শীতল নাকি অন্য একটি মেয়ের খপ্পরে পড়ে কুহেলির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে । শীতলের জীবনে কী হয়েছে সেটা কুহেলির অজানা । তবে একদিনের একান্ত আপন মানুষ ছিল শীতল । সেই মানুষটি নিমেষের মধ্যে পরিবর্তন হয়ে গেলো, এটাই কুহেলির কাছে হিসাব মিলছে না । নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করা ছাড়া আর কোনো অজুহাত খুঁজে পচ্ছে না কুহেলি । তাই কুহেলি এবার নিজের ব্যাপারে খুব সতর্ক । ভেবেচিন্তে পা ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ । সমবয়সী ছেলেদের কোনোরকম প্রলোভনে পা দিতে গররাজি । ইতিমধ্যে সিসগ্রামের তপু বেশ কিছুদিন ঘুরঘুর করছিল । কুহেলি বুঝতে পেরেছিল তপুর মতলব খারাপ । তাই একদিন কুহেলি তপুকে ডেকে বলেছিল, “আমার পেছনে খালি ঘুরঘুর করছো, তোমার মতলব কী ?”
তপু উত্তরে বলেছিল, “আমি তোকে ভালবাসি ।“
কেন আমাকে ভালবাসো, জানতে পারি ?
একসঙ্গে পড়েছি । তোকে আমার ভাল লাগে । সেজন্য ভাল লাগা থেকে তোকে ভালবাসা ।
শোনো তপু, আমি তোমাকে ভালবাসি না । সুতরাং আমার পেছনে ঘোরাঘুরি বন্ধ করো । তোমার ঘোরাঘুরির জন্য গাঁয়ের মানুষ আমাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে ! এটা আমার কাছে বিড়ম্বনার ?
তোর চালচুলোর কিছু নেই ।সুতরাং তোর আবার মান-সম্ভ্রবের জায়গা আছে নাকি ? তোর বড় বড় কথা শুনে হাসি পাচ্ছে ?
“এরপর থেকে তোমাকে যদি আমার পেছনে ঘুরঘুর করতে দেখি, সেদিন বুঝবে আমার মান-সম্ভ্রবের তেজ কাকে বলে ?” চোখ গরম করে বেশ ঝাঁঝালো সুরে কথা শুনিয়েছিল তপুকে । তারপর থেকে তপু আর কুহেলিকে বিরক্ত করেনি ।
**********************************************
এখন কুহেলি সিদ্ধান্ত নিলো, কাকার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবে । কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে শতবার ভাববে এবং তারপর ভেবেচিন্তে এগোবে ।
বড় রাস্তা থেকে কাঞ্চন নগরে ঢোকার মুখে একটা ছোটখাটো বাজার । মুরারী ঘটক কাকার চায়ের দোকান ছাড়া একটি মিষ্টির দোকান এবং মুদিখানার দোকানসহ কইয়েকটি হাতে গোনা দোকান । তবে প্রতিদিন বিকেলে সবজির বাজার বসে । আশেপাশের গ্রাম থেকে চাষিরা নিজের জমির চাষের আনাজ-পাতি নিয়ে বসে । কেননা এলাকার মানুষ চাষবাস নিয়ে ব্যস্ত । অর্থনৈতিক পরিকাঠামো চাষবাসের উপর নির্ভরশীল ! তাই ভোরবেলা থেকে চাষিরা চাষবাস নিয়ে ব্যাস্ত থাকে । বিকেলে ক্ষেতি জমি থেকে ফিরে স্নান সেরে মোড়ে এসে বসেন । গল্পগুজব করেন । চায়ের দফোকানে তখন উপচে পড়া স্থানীয় মানুষের ভিড় । ফেরার সময় তাঁদের নিত্য প্রয়োজনীয় সবজি কিনে ঘরে ফেরেন । ফলে বিকেল থেকে সন্ধে পর্যন্ত জমজমাট বাজার । তবে সন্ধ্যা আটটার পরে মোড় এলাকা প্রায় ফাঁকা । কেননা ঐসব চাষিদের বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে অল্প রাত্রিতে ঘূমানোর অভ্যাস । তার একটাই কারণ পরেদিন ভোর চারটের মধ্যে ঘুম থেকে ওঠে গরু-বাছুরকে খাওয়ানো । হালের বলদ নিয়ে তারপর জমিতে ছোটা । সুতরাং তাঁদের প্রাত্যহিক জীবন ঐভাবেই ছকে বাঁধা । মানুষের অতি সহজ সরল জীবন । তাঁদের চাওয়া-পাওয়ার এলাকা খুব সীমাবদ্ধ । তাঁরা শারীরিক কসরত করে খেয়েদেয়ে বেঁচে থাকতে চায় । তাই তাঁরা সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত । গ্রামের এই চালচিত্র কুহেলির কাছে ছবির মতো পরিষ্কার । তাই সংসার চালানোর কথা মাথায় রেখে রোজগারের চিন্তায় চায়ের দোকান খুলে কুহেলির পয়সা উপার্জনের যাত্রা শুরু ।
ইতিমধ্যে ভরতপুরসহ সালার, কান্দি, এমনকি বাজারসৌ স্টেশনের কয়েকটি চায়ের দোকানে ঘোরাঘুরি করে চা তৈরীর রসায়ন সম্বন্ধে অনেকটাই অবগত । সালারের আলিম চাচা বললেন, “পাতা চা ব্যবহার করলে, জলটা আচ্ছা করে ফোটাতে হবে । তারপর চা পাতা দিয়ে কিছুক্ষণ চা জ্বাল দেওয়ার পাত্র ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে । তাহলে চায়ের লিকারের স্বাদ পাওয়া যাবে এবং খরিদ্দারেরা সেই চা খেয়ে তৃপ্তিবোধ করবেন ।“ অন্যদিকে বাজারসৌ স্টেশনের তপাদার কাকা বললেন, “সিটিসি চা ব্যবহার করলে চা দিয়ে অনেকক্ষণ ফোটাতে হবে । একটু সময় নিয়ে জ্বাল দিলে চায়ের টেস্ট সুস্বাদু হয় ।“ বিভিন্ন চায়ের দোকানদারের বিভিন্ন মতগুলি মনোযোগ সহকারে শুনলো কুহেলি । তারপর বাড়িতে বসে বসে চা বানিয়ে নিজে খেয়ে যাচাই করতে লাগলো । সাতদিন পরে মোটামুটি চা তৈরীর একটা ভাল রসায়ন রপ্ত করলো ।
মোড়ে টেবিল পেতে ছাতা মাথায় দিয়ে দোকান খুললো কুহেলি । সেদিন আবার রথযাত্রা । রথযাত্রার দিন নাকি পুণ্যদিন ! তাই অনেক আগেই রথযাত্রার দিন চায়ের দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কুহেলি । টেবিলে তিন রকমের বিস্কুট রাখা । নোনতা, টোস্ট ও থিন । অস্থায়ীভাবে ইট দিয়ে উনুন বানানো । টেবিলের পাশে কয়লার উনুন । উনুন ধরানোর জন্য গ্রাম থেকে গবরের ঘুটে এনে রেখেছিল । রথেরদিন তার চায়ের দোকানের পথ চলা । কানাই কাকার উপস্থিতিতে চালু করলো চায়ের দোকান ।
কানাই কাকা গাঁয়ের কয়েকজন গণ্যমান্য মানুষকে আগেই নিমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিল । তাঁরা জনা পনের মানুষ এসেছেন । কুহেলি খুব মনোযোগ সহকার অতিথিদের জন্য চা বানালো । গাঁয়ের মানুষ গরুর দুধ দিয়ে চা খেতে অভ্যস্ত । তাই কুহেলি আগেই গরুর দুধ সংগ্রহ করে রেখেছিল । তা ছাড়া আমূলের পাউডার দুধ তো আছেই । তবে কুহেলি গ্রামের সজ্জনদের জন্য গরুর দুধের চা বানালো । নিজে পরখ করে বুঝতে পারলো, চায়ের গুণমান সে যেরকমটি চেয়েছিল ঠিক সেই রকম । কুহেলি চা বানিয়ে খুব খুশী । তার বিশ্বাস, চা খেয়ে গাঁয়ের মানুষকে প্রশংসা করতেই হবে । কী আশ্চর্য ! সকলের নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে কুহেলির কাছ থেকে চা কিনে খেলেন । চা খেয়ে তাঁরা কী উৎফুল্ল !
(চলবে)