হস্তশিল্পে কদর দেওয়া ক্রেতাদের সাথে হারিয়ে যাওয়া হস্ত চালিত তাঁত শিল্পীদের সমন্বয়কারী এক গৃহবধূ চেষ্টা চালাচ্ছে।

নদীয়া, নিজস্ব সংবাদদাতা:- নেট দুনিয়াকে কাজে লাগিয়ে হস্তশিল্পে কদর দেওয়া ক্রেতাদের সাথে হারিয়ে যাওয়া হস্ত চালিত তাঁত শিল্পীদের সমন্বয়কারী এক গৃহবধূ চেষ্টা চালাচ্ছে।
নদীয়ার শান্তিপুরের প্রত্যেক গ্রাম এবং শহর এলাকায় মানুষের প্রতিটি বাড়িই প্রায় কারখানাতে রূপান্তরিত হয়েছিলো একসম়য়। একদিকে বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতিতে অল্প দামে হাতের নাগালে তাঁত শাড়ির বিপুল চাহিদা অন্যদিকে তার সাথে সস্তায় বাজিমাত করা । ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে সমগ্র হস্ত চালিত তাঁত শিল্প।
হস্তশিল্পের সুদক্ষ কারিগর হওয়া সত্ত্বেও দেশে-বিদেশে হোটেল রেস্তোরা, নির্মাণ কর্মীর কাজ বেছে নিয়ে পরিযায়ী শ্রমিক হতে বাধ্য হয়েছেন অভাবের সংসার সামলাতে।
রানাঘাটের মেয়ে বর্তমানে গৃহবধূ মান্ডবী চক্রবর্তী, পুঁথি বিদ্যায় গোল্ড মেডেলিস্ট, রবীন্দ্রভারতীতে সংস্কৃতে পিএইচডি পাঠরতা । কাকা শুভ্রাংশু চক্রবর্তীর কাছে ছবি আঁকা সেখা এরপর ফেব্রিক ক্র্যাফ্টের ওপর বিভিন্ন কাজকর্ম করতেন শখে। 2017 সালে বিবাহ সূত্রে শান্তিপুরের সুত্রাগর এলাকায় আসেন স্বামী অভিক দত্তের বাড়িতে। বাপের বাড়ি হোক কিংবা শশুর বাড়ি এমনকি কোন নিকট আত্মীয়র বাড়িতেও তাঁতের কোনো অস্তিত্ব নেই। বাড়ির কাছে বিখ্যাত তাঁতের হাট হওয়ার সুবাদে মাঝেমধ্যেই সেখানে গিয়ে নিত্যনতুন ডিজাইন, তাঁতিদের সুবিধা ও অসুবিধার কথা শুনতেন তিনি। স্বামী চাকরির সুবাদে সারাদিন থাকেন শান্তিপুরের বাইরে, ছোট্ট একরত্তি মেয়েকে নিয়েই, পৌঁছে যেতেন তাঁতিদের বাড়ি বাড়ি। নিজের আঁকা ছবি শাড়িতে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন তাদের মধ্যে পারদর্শী দুই একজন তাঁত শিল্পীকে দিয়ে। instagram, টুইটার সহ নানান সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করিয়ে শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ক্রেতা র দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে শুরু করেন। একের পর এক হস্ত চালিত তাঁত শ্রমিকের হাতের কাজের মেধা অন্বেষণ এর মধ্য দিয়ে আজ তার ২২ জন সুদক্ষ তাঁতি। এমনকি সারাদিনে ৫০০ থেকে হাজার টাকা উপার্জনের মধ্যে দিয়ে ,মজুরির দিক থেকে টেক্কা দিয়েছেন, উন্নত মেশিনে যন্ত্র চালিত মেশিনে কাজ করা তাঁতিদের কেও। শুধু তাই নয় করোনা পরিস্থিতির মধ্যে যখন, বড় বড় মহাজনরা কাজ দেওয়া বন্ধ করেছিলেন, মান্ডবী দেবী, তার তাঁতিদের মজুরি দিয়ে গেছেন একইভাবে। শান্তিপুর ছাড়িয়ে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালিত তাঁত শিল্পীরা বড় বড় মহাজন ছেড়ে নতুন দিশা দেখেছেন এই গৃহবধূর যোগাযোগে। শাড়ির উপর বিভিন্ন ধরনের নকশা লতাপাতা ফুল এই চিন্তা ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি বিভিন্ন পোর্ট্রেট এর কাজ শুরু করেন। সমস্ত শাড়ির মধ্যে তুলে ধরেন, শ্রীকৃষ্ণের ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত সমস্ত লীলা, গুপী গাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশের বেশ কিছু সিনেমার উদ্ধৃতি সহ অসাধারণ হাতের কাজ,
হাদাভোদা ,নন্টে ফন্টে, অরণ্যদেব,টিন টিনের মতো কমিক্সের বেশ কিছু আকর্ষণীয় সিরিজ,
রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন পর্যায়ের গান, বিখ্যাত গল্প উপন্যাসের বহুল প্রচলিত অংশ , সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল, ভ্যানগর্গের স্টারি নাইট আরো কত কি! সুতোর সূক্ষ্ম বুননে, তবে হ্যাঁ প্রথমে তিনি নিজে আঁকেন ছবি, এরপর সুদক্ষ্য তাঁতীর সাথে আলোচনার ভিত্তিতে, তা রূপ নেয় বারো হাত শাড়িতে। তবে এই শিল্পকর্ম এখন শুধু শাড়িতেই সীমাবদ্ধ নেই, কুর্তি, ধুতি, ড্রেস মেটেরিয়ালস , স্কার্ফ,ওড়না, ঘর সাজানোয় ব্যবহৃত বিছানার চাদর পর্দার কাপড় থেকে শুরু করে বিভিন্ন সৌখিন ঢাকনায় পর্যন্ত বিস্তারিত হয়েছে। মটকা, রেশম, কটন ,তসর ,স্টান সিল্ক ,লিলেন এ ধরনের নানান উপকরণ পার্শ্ববর্তী ফুলিয়াতে পেলেও, গুণগত মান বজায় রাখতে মাঝেমধ্যে তা অন্যান্য রাজ্য থেকেও আনেন।
তবে তার উৎপাদিত পণ্যের কোনো আউটলেট বা দোকান নেই। বিভিন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার নামি দামি কোম্পানি , হস্তশিল্পের গবেষক ছাত্রছাত্রী, এবং গুনমুগ্ধরা তা কিনে থাকেন। তাঁতিরা জানাচ্ছেন, কোন শাড়ি বুনতে সাত দিন সময় লাগে কোনটা বা এক মাস এমনকি ৬ মাস পর্যন্ত বোনা চলে একটি শাড়িতেই, সবটাই কাজের উপর নির্ভর। তবে প্লেন থান একদিনই একটা বুনে ফেলা যায়, সেক্ষেত্রে ৩৫০ টাকার মার নেই, হাতের কাজ অনুযায়ী কেউ মজুরি পান প্রতিদিন হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে এসবই নির্ধারণ হয়, শাড়ির বুনন সমাপ্ত হলে, মাঝে প্রয়োজন ভিত্তিক আনুমানিক হিসেবে টাকা নিয়ে থাকেন তারা, হিসাব নিকাশ শেষ হয়, শাড়ি সমাপ্ত হওয়ার পর।
তবে লভ্যাংশ প্রসঙ্গে বলেন মাণ্ডবী দেবী বলেন লভ্যাংশ এক্ষেত্রে বড় কথা নয়, সংখ্যায় অল্প হলেও একটি অংশ আজও হাতের কাজের খোঁজ করেন, শান্তিপুর তার বহু প্রাচীন উৎস, চোখের সামনে অনেককে বাইরে কাজ করতে চলে যেতে দেখেছি, একটু চেষ্টা করে যদি কিছু মানুষকে কাজ দিতে পারি সেটাই বড় পাওনা। একজন গৃহবধূ হিসেবে সামান্য সময় ব্যয় করে মাত্র কয়েক বছরে ২২ জন শিল্পীর কাজের ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে এত ক্ষমতাশালী সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই বাঁচাতে পারবে হস্ত চালিত তাঁত শিল্প।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *