সুরের জাদুকর সঙ্গীতশিল্পী শচীন দেববর্মণ এর প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

শচীন দেববর্মণ বিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দী গানের কিংবদন্তীতুল্য ও জনপ্রিয় সঙ্গীত পরিচালক , সুরকার , গায়ক ও লোকসঙ্গীত শিল্পী । কিছুটা অনুনাসিক কণ্ঠস্বরের জন্য তিনি তাঁর শ্রোতাদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। প্রায় একশো বছর পার করেও বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে তার কালোত্তীর্ণ গানের আবেদন কিছুমাত্র লঘু হয়নি। কেবল সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে নয়, গীতিকার হিসাবেও তিনি সার্থক। তিনি বিভিন্ন চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর পুত্র রাহুল দেববর্মণ ভারতের বিখ্যাত সঙ্গীতপরিচালক এবং সুরকার ছিলেন। তাঁর ছাত্রী এবং পরবর্তীতে সহধর্মিনী মীরা দেববর্মণ গীতিকার হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন।


তাঁর জন্ম কুমিল্লার ত্রিপুরা রাজবাড়িতে৷ তবে আদিবাস বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে৷ তিনি ছিলেন ত্রিপুরার চন্দ্রবংশীয় মানিক্য রাজপরিবারের সন্তান। বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা শুরু করেন। তৎকালীন ত্রিপুরার অন্তর্গত কুমিল্লার রাজপরিবারের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। মা মণিপুর রাজবংশের মেয়ে নিরুপমা দেবী। ত্রিপুরার আগরতলায় কুমার বোর্ডিং স্কুলে শচীন দেবের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়।


ছোটবেলা থেকেই একটি সংগীতময় পরিবেশে বেড়ে ওঠেন শচীন দেব বর্মন। বাবা ছিলেন একজন সেতারবাদক ও ধ্রুপদী সংগীত শিল্পী। বাবার কাছেই গ্রহণ করেন সংগীতের প্রথম তালিম।১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে হতে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে সঙ্গীতচর্চা করেন। এরপর তাঁর সঙ্গীত শিক্ষা চলে উস্তাদ বাদল খান এবং বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে। ধ্রূপদী সঙ্গীতের এই শিক্ষা তাঁর মধ্যে সঙ্গীতের মৌলিক জ্ঞান সঞ্চারে গভীর ভূমিকা পালন করে। এই শিক্ষা তাঁর পরবর্তী জীবনের সুর-সাধনায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। পরবর্তীতে তিনি উস্তাদ আফতাবউদ্দিন খানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।


শচীন দেব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করে ত্রিপুরার রাজদরবারে কিছুদিন চাকরি করেন। পরে চাকরি ছেড়ে কলকাতায় যান এবং ওস্তাদ বাদল খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, ফৈয়াজ খাঁ, আবদুল করিম খাঁ প্রমুখের কাছে তালিম নেন। ১৯২৩ সালে কলকাতা বেতারে শচীন দেব প্রথম গান করেন এবং ১৯৩২ সালে তার প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশ হয়। এর পর তাঁর বহুসংখ্যক বাংলা ও হিন্দি গানের রেকর্ড বের হয়।তিনি  নজরুল সঙ্গীতও রেকর্ড করেন। এরপর তাঁর বহুসংখ্যক বাংলা ও হিন্দি গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। রেকর্ডকৃত তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গান হলো: ‘যদি দখিনা পবন’ (রাগপ্রধান), ‘প্রেমের সমাধি তীরে’ (কাব্যগীতি), ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে’ (পল্লিগীতি), ‘বধুঁগো এই মধুমাস’ (পল্লিগীতি), ‘ওরে সুজন নাইয়া’ (পল্লিগীতি) প্রভৃতি।
শচীন দেব অনেক বাংলা গানে সুর দিয়েছেন। ১৯৩৪ সালে নিখিল ভারত সঙ্গীত সম্মিলনে গান গেয়ে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৩৭ সাল থেকে পরপর কয়েকটি বাংলা ছায়াছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এক্ষেত্রে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছায়াছবি হলো: রাজগী, ছদ্মবেশী, জীবন-সঙ্গিনী, মাটির ঘর ইত্যাদি।
শচীন দেব ১৯৪৪ সাল থেকে মুম্বাই-এ বসবাস করেন এবং আশিটির মতো হিন্দি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করে চিত্রজগতে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী হন। সেখানে তিনি শিকারী, দেবদাস, সুজাতা, বন্দিনী, গাইড, আরাধনা, বাজি, শবনম, দো ভাই প্রভৃতি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন।


অসংখ্য কালজয়ী গান যেমন তাঁর হাত ধরে এসেছে। ‘তুমি এসেছিলে পরশু, কাল কেন আসোনি?’ কিংবা ‘আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’ অথবা ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’ আরও আছে ‘শোনো গো দখিন হাওয়া’, ‘নিশিতে যাইও ফুল বনে’, ‘কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া’! এখানেই শেষ নয়! ‘তুমি যে গিয়াছ বকুল-বিছানো পথে’, ‘ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের জলে’, ‘ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা’।

তেমনি তিনি গড়ে তুলেছেন এই উপমহাদেশের অনেক বিখ্যাত গায়ক, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালককেও। ভারতীয় সংগীতে তিনি স্রষ্টার মতো। গানের আঙিনায় তাঁকে সম্মান করে ডাকা হয় ‘কর্তা’ বলে। লোকজ ও রাগ সংগীতের সংমিশ্রণে সংগীত ভুবনে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন তিনি।

শচীন দেববর্মণ তাঁর সংগীত জীবনে অসংখ্য গানের সুর করেছেন, যার অধিকাংশ গানই লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে, কিশোর কুমার, মো. রফি ও আশা ভোসলের মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের গাওয়া। তিনি প্রায় অর্ধশতাধিক চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনাও করেছেন।
শচীন দেববর্মণের পুত্র রাহুল দেববর্মণও ভারতের বিখ্যাত সঙ্গীতপরিচালক এবং সুরকার ছিলেন। তাঁর ছাত্রী এবং পরবর্তীতে সহধর্মিনী মীরা দেববর্মণ গীতিকার হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে শচীন দেব বর্মন জয় করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, পদ্মশ্রী, ফিল্মফেয়ার এশিয়ান ফিল্ম সোসাইটি পুরস্কার, সহ  বহু সন্মাননা। শচীন দেব বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে উচ্চ পদ অলঙ্কৃত করেন এবং বহু সংগঠন কর্তৃক সম্মানিত হন। ১৯৫৮ সালে সঙ্গীত-নাটক আকাদেমি ও এশিয়ান ফিল্ম সোসাইটি (লন্ডন) এবং ১৯৬৩ সালে ত্রিপুরা ললিতকলা কেন্দ্র তাঁকে অভিনন্দিত করে। 


১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর মুম্বাইয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সংগীতের এই কিংবদন্তি। তাঁকে এস ডি বর্মণ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *