নৈসর্গিক জীবনের কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি : দিলীপ রায়।

0
339
 আমাদের দেশের প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ  বন্দোপাদ্যায়কে শৈশব থেকেই মুগ্ধ করত  । যার জন্য তিনি নিবিড়ভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছেন গ্রাম বাংলার এখানে সেখানে লুকিয়ে থাকা ঝোঁপ-জঙ্গল, লতা-পাতা, বিভিন্ন ধরনের ফুল, নানান প্রজাতির পশু-পাখি, পথ-ঘাট, নদী-নালা, ইত্যাদি । পরবর্তী কালে  প্রকৃতির প্রতি  তাঁর অগাধ ভালবাসার  অভিজ্ঞতা নানাভাবে তাঁর রচনাকে প্রভাবিত ও  সমৃদ্ধ করেছে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়  । তাঁর অনুভবী এবং সংবেদনশীল মন দিয়ে প্রকৃতির অসামান্য রূপ বর্ণনা করে সাহিত্য সম্ভারকে অন্যতর ভূমিকায় উদ্ভাসিত করেছেন । সেই কারণে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি,   তাঁর সৃজনশীল সাহিত্য প্রতিভা, অবর্ণনীয় ! 
   বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১২ই সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতবর্ষের বাংলা প্রদেশের চব্বিশ পরগণা জেলার কাঁচরাপাড়ার সন্নিকট ঘোষপুর-মুড়াতিপুর গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন  ।  তিনি ছিলেন প্রখ্যাত মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৃণালিনী দেবীর পাঁচটি সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সন্তান, অর্থাৎ বিভূতিভূষণ দুই ভাই এবং  তিন বোনের মধ্যে ছিলেন সবার বড় । তাঁর বাবা  ছিলেন  তদানীন্তনকালের একজন প্রখ্যাত সংস্কৃত বিষয়ক পণ্ডিত  । মহানন্দ বন্দোপাধ্যায়ের পাণ্ডিত্য  ও  কথকতার জন্য শাস্ত্রী উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন । উল্লেখ থাকে যে, তাঁদের আদি নিবাস ছিল যশোর জেলার ( বর্তমান চব্বিশ পরগনা জেলার ) অন্তর্ভুক্ত বনগ্রাম মহকুমায় অবস্থিত ইছামতী নদীর তীরে ব্যারাকপুর গ্রামে । শোনা যায়  বাবা মহানন্দ বন্দোপাধ্যায় কথকতা ও পৌরাহিত্য করতেন বলে,  তাঁর  বাল্য ও কৈশোর জীবন কাটে দারিদ্র্য , অভাব  ও  অনটনের মধ্যে । বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে গৌরী দেবী  ও পরে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে রমা দেবীর সাথে দাম্পত্য জীবনে আবদ্ধ হন । 
  এবার আসছি তাঁর শিক্ষা জীবন সম্পর্কে  ।  বাবা মহানন্দ বন্দোপাধ্যায়ের কাছে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের শিক্ষার হাতেখড়ি  । লেখাপড়ার পাঠ শুরু  । ছোট থেকেই মেধাবী হওয়ার কারণে নিজ গ্রামের  পাঠশালায় পড়াশোনার পর বনগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ে অবৈতনিক শিক্ষার্থী হিসাবে ভর্তি হন  । ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে বনগ্রাম হাইস্কুল থেকে এনট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন । ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার রিপন কলেজ (অর্থাৎ বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে আই-এ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন । ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে রিপন কলেজ থেকেই বি.এ পরীক্ষায় ডিস্টিংশন সহ উত্তীর্ণ হন । উচ্চতর পড়াশোনার জন্য এম.এ ও আইন বিষয়ে ভর্তি হন । কিন্তু পরিবারের চাপে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে পড়াশোনা ছেড়ে দেন।
   এবার আসছি তাঁর কর্ম জীবন সম্পর্কে ।   হুগলী জেলার জাঙ্গিপাড়া গ্রামের বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে পেশাগত জীবনে প্রবেশ । এরপরে সোনারপুর হরিনাভী স্কুলেও শিক্ষাকতা করেন  । ঐ সময়ে গৌরী দেবীর মৃত্যু হলে মনের কষ্টে  সন্ন্যাস গ্রহণ করেন । সেখান থেকে ফিরে এসে খেলৎচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে গৃহ শিক্ষক ও সেক্রেটারি হিসাবে কাজ  করা শুরু করেন । পরবর্তীকালে  খেলৎচন্দ্রের  সুপারিশ ক্রমে ভাগলপুর সার্কেলের সহকারী ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন  । ভাগলপুরে প্রবাসী হিসাবে বসবাস করতে থাকেন, এখানেই তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস “পথের পাঁচালী” রচিত হয় । এভাবে কিছুদিন কাটানোর পর ধর্মতলায় খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতা করেন । পরে বনগাঁর নিকট গোপালনগর হরিপদ ইনস্টিটিউশনে আমৃত্যু জীবন পর্যন্ত  শিক্ষাকতা করতে থাকেন ।
     সাহিত্য সম্বন্ধে আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় “উপেক্ষিতা”  নামক গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে  তাঁর সাহিত্য জীবনে সূত্রপাত  ।  ভাগলপুরের বাঙালিটোলায়  জমিদারির সেরেস্তায় নায়েবের কাজ নিয়ে চলে আসার পর “পথের পাঁচালী” উপন্যাস লেখার মধ্য দিয়ে ভাগলপুরে তাঁর লেখকজীবনের সূত্রপাত  ।  উল্লেখ থাকে যে,  ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ভাগলপুরে বসবাস কালীন  সময়ে  “পথের পাঁচালী”  রচনা শুরু   এবং ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সেই লেখার শেষ  ।  এই ভাগলপুরের বাঙালিটোলায় লেখক বিভূতিভূষণকে আবিষ্কার করেন যিনি, তাঁর নাম উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় । এখানে একটা কথা ভীষণ প্রাসঙ্গিক,  উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্য ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন দুজন বিখ্যাত সাহিত্যিককে আবিষ্কার করার কারণে । তাঁদের মধ্যে প্রথমজন হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর দ্বিতীয়জন হলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় । উপেন্দ্রনাথ একদিকে সাহিত্যপাগল, অন্যদিকে মজলিসি । তাঁর বাড়ির কাছারিঘরে নিত্যদিন জমজমাট সাহিত্য আড্ডা বসতো । সেই আড্ডায়  অপরিচিত যুবক বিভূতিভূষণের ছিল নিত্য যাতায়াত । বৈঠকখানার সেই আড্ডায়  বিভিন্নরকম  সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা ও  মন্তব্যে সকলে মেতে উঠতেন । কিন্তু এই যুবকটি কোনো আলোচনায়  অংশগ্রহণ করতেন  না । একদিন বৈশাখ মাসের  বিকেলের আড্ডায় কেউ উপস্থিত হলেন না ।  উপেন্দ্রনাথ কাছারিঘর থেকে নেমে উঁকি দিয়ে দেখলেন বাইরে রাস্তার উপরে একটি লণ্ঠনের  আলো,  সঙ্গে একটা ছায়ামূর্তি । সেই  ছায়ামূর্তি এসে হাজির হলো তাঁর বৈঠকখানায় । আড্ডারঘরে  একেবারে পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বিভূতিভূষণ বসলেন । উপেন্দ্রনাথ বললেন, “একি ! আপনি পেছনে বসলেন কেন ?” প্রত্যুত্তরে বিভূতিভূষণ বললেন, “আরো অনেকে আসবেন, আমি কীভাবে সামনের বেঞ্চটিতে বসি ।“   উপেন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “আজকে মনে হচ্ছে আর কেউ আসবেন  না । আসুন, আপনি সামনের চেয়ারটাতে বসুন ।“  নানাবিধ গালগল্পের মধ্যে উপেন্দ্রনাথ হঠাৎ বিভূতিভূষণকে জিজ্ঞেস করলেন, তা আপনার কবিতা কিংবা গল্প-উপন্যাস লেখার বাতিকটাতিক আছে নাকি ? বিভূতিভূষণ উত্তরে বললেন,  “না, তেমন কিছু নয়,  একটা উপন্যাস লিখেছি ।“  কিন্তু লেখাটি আদৌ মানসম্পন্ন হয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না ! উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বিভূতিভূষণকে উদ্দেশ্য করে বললেন,  “তাহলে উপন্যাসের খাতাটি একবার নিয়ে আসুন । দেখি কেমন উপন্যাস লিখেছেন আপনি ?”  এই কথোপকথনের  কয়েক দিনের মধ্যে  বিভূতিভূষণ তাঁর  “পথের পাঁচালী”  উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে গেলেন উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে । তারপর কিছুদিন বাদে একদিন মজলিস শেষে সবাই যখন উঠে  যাচ্ছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে উপেন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণকে বললেন,  “আপনি এখনই যাবেন না । আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে ।“ 
সাহিত্য আসর থেকে সবাই বিদায় নেওয়ার পর উপেন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণকে বললেন,  “ভাই, আপনার হবে । হবে বলছি কেন ?  আপনার লেখা ভাল হয়েছে । কী এক অসাধারণ উপন্যাস লিখেছেন আপনি ! লেখাটা পড়েই মন-প্রাণ দুটিই জুড়িয়ে গেছে আমার । যাই হোক, এবার আসল কথা বলি, আমি ভাগলপুরে আর থাকছি না । কলকাতায় চলে যাচ্ছি । তবে আমার কলকাতায় যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সেখান থেকে একটি পত্রিকা বের করব ‘বিচিত্রা’ নামে । সেখানেই  আমি ছাপতে চাই  আপনার এই  উপন্যাসটি । আপনার এই উপন্যাস দিয়েই যাত্রা শুরু করবে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকাটি । এর  কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করল বিচিত্রা এবং বিভূতিভূষণের উপন্যাসও কিস্তিতে কিস্তিতে ।  উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যরসিক পাঠকমহলে গুঞ্জন শুরু হলো—কে এই লেখক ? যে সমাজ ও দেশ-গ্রামের তুচ্ছ জিনিসগুলো এত মনোমুগ্ধ করে তাঁর লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন  । হঠাৎ একদিন ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এসে উপস্থিত । নব্বই  টাকা দিয়ে বললেন—"বিভূতিবাবু, আপনি যদি অনুমতি দেন, তবে “পথের পাঁচালী”  উপন্যাসটি বই আকারে ছাপব ।“  এভাবেই শুরু বিভূতিভূষণের পথচলা ।

এই উপন্যাসটি ছিল বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের প্রথম ও সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকৃতী যা পরবর্তি কালে চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় “পথের পাঁচালী” চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে বিখ্যাত হয়ে ওঠে । এছাড়াও তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘অপরাজিত’ রচনা করেন, যা ছিল পথের পাঁচালী উপন্যাসের পরবর্তী অংশ । এই দুই উপন্যাসের কাহিনীই ছিল তাঁর জীবনকেন্দ্রিক । চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাসের কাহিনীর মাধ্যমে দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যা ভীষণ ভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে । ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কিশোর পাঠ্য ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাস ভারতবর্ষের তরুণদের কাছে অতি জনপ্রিয় ও রোমাঞ্চকর উপন্যাস। ২০১৩ সালে চিত্র পরিচালক কমলেশ্বর মুখার্জির পরিচালনায় ‘চাঁদের পাহাড়’ চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে যথেষ্ঠ খ্যাতি অর্জন করে ।
পুরস্কার হিসাবে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ইছামতী উপন্যাসের জন্য ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কার পান । এছাড়াও তাঁর জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বনগাঁ মহকুমার পারমাদান বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের নাম লেখকের সম্মানার্থে “বিভূতিভূষণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য” রাখা হয়েছে ।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ জীবনের কয়েকটি বৎসর তাঁর ভালোবাসার শেষ চিহ্ন গৌরীকুঞ্জতে কাটিয়েছেন । তিনি তার বাড়িটির নাম স্ত্রীর নামে ‘গৌরীকুঞ্জ’ রেখেছিলেন ।
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় (অধুনা ঝাড়খণ্ডের) ৫৬ বৎসর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন । বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের সৃষ্টির গুনে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন আজীবন । তাঁকে আমার শতকোটি প্রণাম । (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত) ।
——–০———

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here