বৃন্দাবনের গোবর্দ্ধনে বাস করতেন শ্রীকৃষ্ণদাস নামক এক সাধু । তিনি গোফার মধ্যে ভজন করতেন । দিবানিশি কৃষ্ণ নাম অতি উচ্চঃস্বরে করতেন। নাম নিতে নিতে এমন হতো যে ক্ষুধা-তৃষ্ণা, আহার-বিহার সব ভুলে যেতেন । নামানন্দে বিভোর হয়ে থাকতেন সর্বদা । কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে এমন করে করুণ সুরে ডাকতেন যে, শুনলে প্রাণ কেমন করে উঠতো । কৃষ্ণপ্রেমে উন্মত্ত সাধু কৃষ্ণদাস প্রেমানন্দে মজে থাকতেন সদা সর্বদা।
একদিন কৃষ্ণ দাসের গোফার দ্বারে বিশাল আকারের এক বাঘ এসে দাঁড়ালো। ভয়ংকর উগ্র মূর্তি সেই বাঘের। দেখলেই ভয় লাগবে এমন। তবে কৃষ্ণদাস কিন্তু একটুও ভীত হলেন না। মনে মনে বাঘটিকে অতিথি ভাবলেন তিনি । বহু সম্মান দেখিয়ে একটি আসন গোফার দ্বারে পেতে বাঘটিকে আদরের সুরে বসতে বললেন । আর , বাঘটিও সুরসুর করে আসনের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নিতে বসে পড়লো যেন।
যত্ন করতে হবে বাঘটিকে । কৃষ্ণদাস ভাবতে থাকলেন অতিথি এসেছে, কেমন করে আতিথেয়তা করি ? কী খেতে দেই তাকে ? ঘরে তো কিছুই তেমন নেই !
কৃষ্ণদাস নিজেই মাধুকরী করে এনে প্রসাদ পান। ঘরে সঞ্চয় বলতে কিছুই থাকে না ! তার ওপর বাঘ আবার মাংসাশী প্রাণী। মাংস এখন কোথায় পাই ? অতিথিকে তুষ্ট করার কথা ভাগবতেও আছে। বলা হয়েছে , ক্ষমতা না থাকলে নিদেনপক্ষে বসার আসন আর পান করার জলটুকু দিয়েও অতিথি সৎকার করা উচিৎ। কিন্তু, মাংস ভিন্ন অপর কিছু দিয়ে তো আর বাঘ-অতিথিকে খুশী করা যাবে না ! —–এইসব নানান ভাবনার উদয় হল কৃষ্ণদাসের মনে। পরক্ষণেই কৃষ্ণদাস ভাবলেন , আমার নিজের অঙ্গের মাংসতেই যদি বাঘকে সম্মান জানাই, তবে কেমন হয় ? সেটাই বরং ভালো হবে। আর তাই কৃষ্ণদাস নিজের অঙ্গের নানান জায়গায় ছুরি চালিয়ে টুকরো টুকরো মাংস কেটে বের করে আনলেন। কষ্ট , যন্ত্রণা কী হচ্ছিল না তাঁর ? হচ্ছিল , অবশ্যই হচ্ছিল । কিন্তু, নিজের মনকে তিনি শ্রীমন্ মহাপ্রভুর মুখবাক্যের কথা ভেবেই বোঝাচ্ছিলেন যে , “সর্বজীবে দিবে সম্মান । জানি কৃষ্ণ অধিষ্ঠান।।” অর্থাৎ, প্রতিটি জীবের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ অবস্থান করেন । তাই প্রতিটি জীবকে সম্মান দিতে হয় । জীবসেবার চেষ্টা করতে হয়।
বাঘের সম্মুখে পাতায় করে কৃষ্ণদাস রেখেদিলেন নিজের শরীরের কয়েকটি ছোট মাংসখণ্ড । বাঘ তৃপ্তি ভরে খেল। আর তারপর চুপচাপ চলে গেল। কৃষ্ণদাস তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে মনে মনে তৃপ্তি পেলেন এই ভেবে যে , যাক অতিথি আপ্যায়নটুকু তো কোনমতে হল !
কৃষ্ণ ভক্তের স্বভাব যে এমনই হয়। নিজের দুঃখ বা লাভালাভে কোন আকর্ষণ থাকে না তাঁদের । অপরকে সুখী করেই তাঁরা আনন্দ পান।