শ্রীনগর ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের রাজধানী। এখানে ১০ লক্ষের বেশি লোকের বাস। শহরটি ঝেলুম নদীর তীরে কাশ্মীর উপত্যকায় অবস্থিত। শীতকালে প্রবল শীতের কারণে অঙ্গরাজ্যটির রাজধানী ছয় মাসের জন্য জম্মুতে স্থানান্তরিত করা হয়। শ্রীনগর একটি পর্যটন কেন্দ্র। এখানকার হ্রদ, পাহাড়, সবুজ মাঠ, বার্চ ও উইলো গাছে পূর্ণ অরণ্য পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এখানকার বিভিন্ন কুটির শিল্পও বিখ্যাত। এদের মধ্যে কার্পেট, রেশম ও পশমের বস্ত্র, কাঠ ও চামড়ার কাজ উল্লেখযোগ্য। শহরের ভেতরে ও বাইরে বহু প্রাচীন ভবন ও ধ্বংসাবশেষ আছে। ১৯৬৯ সালে এখানে শ্রীনগ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ৭ম শতকে নির্মিত একটি মসজিদ এবং ১৬শ শতকে নির্মিত একটি দুর্গ আছে। কাছেই অনেক বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে। শহরটি খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
শ্রীনগর (Srinagar), জম্মু ও কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী এবং “প্রাচ্যের ভেনিস” হিসাবে পরিচিত যা পশ্চিম কাশ্মীরের ঝিলম নদীর তীরে অবস্থিত। এটি যেমন তুষারপাতের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ করিয়ে দিতে পারে, তেমনি দীর্ঘদিন ধরে এখানে থাকার স্মৃতি বা বাতাসের সামান্য আঁচড় আপনাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে। মসজিদ, মন্দির এবং সমাধি আপনাকে এক বিশ্ব সৌন্দর্য্যমুখর অভিজ্ঞতা দিবে। হাউসবোটে রাত্রিযাপন, লক্ষ লক্ষ মনোমুগ্ধকারী টিউলিপ সমন্বিত একটি বাগানে পায়চারি ও তাদের মাথা দোলানো প্রাণবন্ত নৃ্ত্য এবং উচ্চতর উচ্চতায় লেক বরাবর ট্রেকিং – অসাধারণ গন্তব্যস্থল হিসাবে শ্রীনগরকে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ আছে।
দর্শনীয় স্থান
চশমা শাহী
১৬৩২ সালে আলী মর্দান খান মুঘল গর্ভনর মিষ্টি জলের স্প্রিং এর উপর এই উদ্যান তৌরী করেছিলেন। মুঘল বাদশা তার বড় রাজপুত্র দারা শিখকে উপহার দিয়েছিলেন। রুপা ভবানী এক মহিলা সন্যাসী এই প্রাকৃতিক স্প্রিং আবিষ্কার করেছিলেন। এই স্প্রিংকে আগে বলা হত চশমা সাহিবি লোক মুখে অপভ্রংশ হয়ে চশমা শাহী হয়ে গেছে। উদ্যানটি তিন ভাগে বিভক্ত। সব থেকে উপরে যেখান থেকে জলধারা নালা বাহির হচ্ছে সেখানে দুই-তলা কাশ্মিরি হাট আছে। দ্বিতীয় চত্বরে জলপ্রপাত হয়ে নীচে নামছে। তৃতীয় চত্বর এখানে পাঁচটি ঝর্ণা বর্গাকারে আছে। এখান দিয়েই প্রবেশ দ্বার। সাধারণত মুঘল গার্ডেনে ফুল ফোটে মে জুন মাসে তখন বাগান দেখতে খুব ভালো লাগে।
পরী মহল—
পরী মহল, একটি সাত তলা বিশিষ্ট উদ্যান। মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার বড় রাজপুত্র দারা শিখহ’র জন্য গ্রন্থাগর ও আবাসস্থল হিসাবে নির্মিত হয়েছিল ১৬০০ শতকের মাঝা মাঝি সময়ে। এখানে দারা শিখহ জ্যোতি বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করত। পরি মহল ইসলামী স্থাপত্য ও শিল্পের উপর নির্মিত। এখান থেকে ডাল লেক ও শ্রীনগর শহর খুব সুন্দর ভাবে দেখা যায়।
ডাল লেক–
ডাল লেক (Dal Lake), তার হাউসবোট এবং শিকারার জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয়। সেই সাথে পূ্র্ণ বিকশিত পদ্মফুল ও নির্মলতার জন্যও ডাল লেকের সুখ্যাতি আছে। ২৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রসারিত, হ্রদ বা লেকটি চারটি ভাগে বিভক্ত রয়েছে, যার মধ্যে নাগিন লেক হল একটি অন্যতম। কায়াকিং থেকে সাঁতার এবং ক্যানোয়িং থেকে হাউসবোটে থাকার অভিজ্ঞতা সহ ডাল লেক গ্রীষ্মকালে প্রচুর চিত্তবিনোদনের সুযোগ প্রদান করে।
নাগিন লেক—
“আংটির মধ্যে মণি” হিসাবে উন্নীত নাগিন লেক (Nigeen Lake), অনেকের কাছে ডাল লেকের এক বিচ্ছিন্ন অংশ রূপে পরিচিত কিন্তু এটি আসলে একটি সংকীর্ণ কজওয়ে বা উঁচু বাঁধের দ্বারা সংযুক্ত আছে। পর্যটকরা সেখানে প্রচুর হাউসবোট পেয়ে যাবেন। হ্রদটি নিস্তব্ধতা এবং নির্মলতা উপলব্ধ করায়।
জামা মসজিদ—
১৬৭৪ সালে নির্মিত জামা মসজিদ, শ্রীনগরের মসজিদগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীনতম। চারটি কুন্ডলী, ৩৭০-টি স্তম্ভ ও প্রার্থনা সভার সমন্বয়ে গঠিত মসজিদটি ইন্দো-শারাসেনিক স্থাপত্যের এক নিদারুণ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মসজিদটির প্রতিটি স্তম্ভ হিমালয়ের সেডার (দারূবৃক্ষবিশেষ) কান্ডের একক খন্ডের দ্বারা নির্মিত। মসজিদটি তার ইতিহাসের ধারায় বহুবার বিপর্যস্ত ও পুনরুদ্ধার হয়েছিল। এটি ফ্রাইডে মসজিদ বা শুক্রবার মসজিদ নামেও পরিচিত।
হজরৎবল মসজিদ
ডাল লেকের তীরে অবস্থিত, মসজিদটি সাদা মার্বেলের তৈরি। কাশ্মীরের এক বিরল ঐক্যবন্ধন এবং মুঘল শৈলীর স্থাপত্য, হজরৎবল মসজিদ দরগাহ শরিফ নামেও পরিচিতি লাভ করেছে। নবী মুহাম্মদের চুলের একটি সূত্রে – এই পবিত্র আধারটি একটি ধ্বংসাবশেষকে ধারণ করে আছে বলে মনে করা হয়।
শঙ্করাচার্য মন্দির
শঙ্করাচার্য পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত, এই মন্দিরটি প্রায় খ্রীষ্টপূর্ব ২০০ শতকে, সম্রাট অশোকের পুত্র জালুকা-র দ্বারা নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। অনেক ঐতিহাসিকদের ধারণা অনুযায়ী এটি একটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল, যেটি আদি শঙ্করাচার্য, প্রভু শিবের প্রতি উৎসর্গীকৃত, হিন্দুদের পূজার্চনার জায়গা হিসাবে রূপান্তরিত করেন। পাহাড়ের চূড়া থেকে, দর্শকেরা শ্রীনগর এবং পীর পাঞ্জল পর্বতমালার তুষারাবৃত পর্বতশ্রেণীর একটি সামগ্রিক দৃশ্য পরিদর্শন করতে পারেন।
শ্রী প্রতাপ সিং মিউজিয়াম—
১৮৯৮ সালে প্রতিস্থাপিত, মিউজিয়ামটিতে উশকূরের একটি বৌদ্ধ স্থান থেকে সংগৃহীত, তৃতীয় শতকের অন্তর্গত কিছু বিরল পোড়ামাটির মূর্তি, হারওয়ান থেকে চতুর্থ এবং পঞ্চম শতাব্দীর সময়কালীন বিভিন্ন ঢালাই পোড়ামাটির ফলক, লোকেশ্বরের একটি প্রাচীন পিতলের মূর্তি এবং গান্ধার স্থাপত্য শৈলীতে, পঞ্চম শতকের একটি বুদ্ধ চিত্র এখানে প্রদর্শিত রয়েছে। এছাড়াও যাদুঘরটিতে প্রাচীন মূদ্রা, সঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্র, পাণ্ডুলিপি, ক্ষুদ্র অঙ্কন, হাতিয়ার ও অস্ত্রসম্ভার, বস্ত্র, ভাস্কর্য এবং চামড়া, ঘাস ও কাঠের কারুকার্যময় দ্রব্য-সামগ্রীও রয়েছে।
ইন্দিরা গান্ধী টিউলিপ গার্ডেন—-
এশিয়ার সবথেকে বড় টিউলিপ উদ্যান হলো ইন্দিরা গান্ধী টিউলিপ গার্ডেন। কাশ্মীর উপত্যকায় নুতন পর্যটন মরুশুমের সূচনা হয় টিউলিপ উদ্যান উদ্বোধন দিয়ে। পূর্বে সিরাজ বাগ নাম ছিল। ২০০৮ সালে তৎকালীন কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী গুলাম নবী আজাদ নাম বদল করে নাম দেন ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল টিউলিপ গার্ডেন। জাবরওয়ান রেঞ্জের তলদেশে ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছে ৩০ হেক্টর জুড়ে বাগান। ২০১৯ সালে ১২ লাখ টিউলিপ বাল্ব ৫১টি বিভিন্ন ধরনের টিউলিপ লাগান হয়েছিল। এছাড়া ১২ ধরনের Hyacinth, Daffodil, Ranunculus অন্যান্য রকমের ফুলও লাগানো হয়েছিল। টিউলিপ ফুল সতেজ জীবন কাল তিন থেকে চার সপ্তাহ। ডিরেক্টর ফ্লোরিকালচার আব্দুল হাফিজ সাহেব আসা করেন যে এমন ভাবে টিউলিপ বাল্ব লাগান হবে যাতে দুই মাস ধরে টিউলিপ গার্ডেন জনগণের জন্য খোলা রাখতে পারেন।
নিশাত বাগ—-
নিশাত বাগ শ্রীনগরের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুঘল গার্ডেন। এর পিছনে জাবর ওয়ান মাউন্টেন রেঞ্জ। সেখান থেকে ১২ টি চত্বরে বিভক্ত, মানে ১২টি রাশিচক্র নিদর্শন করে ধাপে ধাপে নীচে নেমে এসে ডাল লেকের ধারে মিশেছে। ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে নূরজাহান এর বড় ভাই আসিফ খান পারস্যের উদ্যানের মডেলে হলেও বর্গাকার রূপের পরিবর্তে আয়তক্ষেত্রের রূপে চত্বর কাশ্মিরী ভ্যালির অনুরুপে তৈরি করেন। গোপী তৃষ্ণা নামে এক স্প্রিং এর পরিষ্কার জল উপর থেকে ঝর্ণা প্রবাহিত হয়ে রাস্তা অব্দি নেমেছে। চিনার ও সাইপ্রাস গাছের আধিক্য, আসে পাশে কিছু পুরান মুঘল ভবন আছে। ফুল দেখার ভাল সময় মে জুন মাস, ঐ সময় প্রতিটি মুঘল গার্ডেন খুব চিত্তাকার্ষক হয় কারন বাগান একদম ফুলে ভরা থাকে।
দচিগাম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য—
পর্বত দ্বারা বেষ্টিত এবং তৃণভূমি ও পাথুরে পর্বতগাত্রের সঙ্গে চিহ্নিত, অভয়ারণ্যটি প্রায় ১৪১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। ১৯৮১ সালে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষিত, অভয়ারণ্যটি ব্যাপক বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের আশ্রয়স্থল, বিশেষত আ্যভিফৌনা প্রজাতি ও হাঙ্গুল বা কাশ্মিরি হরিণ। উদ্যানটিতে প্রবেশের জন্য বিশেষ অনুমতিপত্র প্রয়োজন।
শ্রীনগর ভ্রমণের সেরা সময়—
শ্রীনগর, সারা বছর ধরে মনোরম আবহাওয়ার সঙ্গে আশীর্বাদিত থাকে, সুতরাং পর্যটকেরা যে কোনও সময় শ্রীনগর পরিদর্শনে আসতে পারেন।
।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।