চোখের সামনে একটি রক্তাক্ত ক্রুশবিদ্ধ মানুষের নিথর শরীর এড়িয়ে এক পবিত্রময় আলোর প্রশান্তি, সেই দুঃখী মানুষটির মুখ জুড়ে! শান্ত স্থীর মোমবাতির আলোয় সমস্বরে প্রার্থনা সুর, অদ্ভুত এক মায়াজালের মতো সুখ ছড়াতো মনে!
চারিদিকে ঝকঝকে ব্যস্ত পথ- পথের মানুষ.. সব ঠেলেঠুলে পাড়ার স্কুল গীর্জায় চুপচাপ ঢুকে যেতাম প্রার্থনা গৃহে!
পুরোনো শহরের ৪৭ নম্বর বাড়িটিতে যখন আমার ছেলেবেলা, বলতে গেলে ষোলআনা বাঙালি পরিবারে বেড়ে আমার উৎসুক শিশু চোখে তখন ‘বড়দিন’ মানে একটি বিশাল প্রশ্ন চিহ্ন! আমাদের পাশাপাশি কিছু খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী পরিবারের উৎসব উৎযাপনটা তখন আমার শিশুমনে বেশ আকর্ষণীয় ও লোভনীয় মনে হতো! সারাবছর এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম, সকাল হলেই স্কুল ছুটির দিনে মজার মজার বাহারী কেক-মিষ্টি-চকলেট-কমলা লেবুর জন্য। মা বলতেন, “আজ থেকে বছরে দিন বড় আর রাত ছোট হতে শুরু হলো, বুঝলি”।
দিনের এই ছোট বড় হওয়া নিয়ে তখন আমার তেমন কোন মাথা ব্যথা ছিলো না, যতোটা ছিলো সন্ধ্যে হলে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণীর সমস্বরে প্রার্থনা গান নিয়ে। বিশাল বাড়িটাতে আমরা সব শিশুরা মিলে বারান্দার গ্রিল ধরে ভিড় করে নিচের পাকা দূয়ারে মুগ্ধ হয়ে গান শুনতাম। সব মিলিয়ে “বড়দিন” ব্যাপারটাই ছিলো অসাধারণ এক আনন্দের। আমার কাছে কোথায় যেন “বড়দিন” কে মনে হতো পৃথিবীর সব মানুষের মন ভালোর দিন।
প্রায় দুহাজার বছর আগে রোমীয় সম্রাটের আদেশে নাসরত শহর থেকে পরিপূর্ণ বেথলেহেম শহরে গিয়ে আশ্রয়হীন হলেন এক দম্পতি, কাঠুরে যোসেফ আর তার স্ত্রী মেরি । যাত্রার মাঝপথেই এক গোয়ালঘরে মাতা মেরীর প্রথম সন্তান হিসেবে জন্ম নিলেন বিশ্বে শান্তির বাণী ছড়িয়ে দিতে
খ্রিষ্ট ধর্মের প্রবর্তক, ইতিহাসে ‘ঈশ্বরের পুত্র’ নামে খ্যাত ভগবান ‘যিশু খ্রিষ্ট’!
যাকে জন্মক্ষণে পান্থশালায় স্থান না পেয়ে যাবপাত্রে শুইয়ে রেখেছিলেন তার মাতা মেরি! ভগবান যিশুর জন্ম-সংক্রান্ত প্রথম দিকের চিত্রগুলিতে গবাদি পশু ও যাবপাত্র পরিবৃত একটি গুহায় যিশুর জন্মদৃশ্য বহুল প্রচলিত।
ধারণা অনুযায়ী, এটি বেথলেহেমের চার্চ অফ দ্য নেটিভিটির অভ্যন্তরে। কথিত যে এক স্বর্গদূত বেথলেহেমের চারিপার্শ্বস্থ মাঠের মেষপালকদের যিশুর জন্ম সম্বন্ধে অবহিত করেন, এই কারণে তাঁরাই সেই দিব্য শিশুকে প্রথম দর্শন করার সৌভাগ্য অর্জন করেন!
মথিলিখিত সুসমাচার অনুসারে,
‘বেথলেহেমের তারা’ নামে পরিচিত একটি রহস্যময় তারা কয়েকজন ম্যাজাইকে (জ্যোতিষী) পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেন শিশু যিশুর কাছে, যারা স্বর্ণ, গন্ধতৈল ও ধূপ নিয়ে ঈশ্বরের পুত্রকে দর্শন করতে যান।
ক্রিসমাস অলঙ্কারে ক্রিসমাস ট্রি (পাইন গাছ) বড়দিনের ঘর সাজানো বড়দিনের উৎসবকে পূর্ণতাএনে দেয়। পাশাপাশি
আলোর মোমবাতি যা কিনা মানুষের কাছে প্রেম, প্রার্থনা, আবেগের প্রতীক! বড়দিনের দিন খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছে মোমবাতি ‘খ্রীষ্টের আলো’ হিসাবে পবিত্র । আগের রাতে নানান রংচঙয়ে ছোট ছড়া বাতি দিয়ে সাজানো ক্রিস্টমাস ট্রি, ছোট ছোট ক্রিসমাস বেল দিয়ে সাজানো হয়, এই ঘণ্টাটি আভাস দেয় “বড়দিন” এসে গেছে।
বড়দিনে সান্টার লাল টুপি আজকের শিশুদের খুব মন-প্রিয়।
আজকের আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বেও ‘বড়দিন’ প্রকৃতিগতভাবে একটি খ্রিষ্টীয় ধর্মানুষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও, একাধিক অ-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ও মহাসমারোহে উৎসবটি পালন করে থাকে! উপহার প্রদান, সংগীত, বড়দিনের কার্ড বিনিময়, গির্জায় ধর্মোপাসনা, ভোজ, এবং বড়দিনের বৃক্ষ, আলোকসজ্জা, মালা, মিসলটো, যিশুর জন্মদৃশ্য, এবং হলি সমন্বিত এক বিশেষ ধরনের সাজসজ্জার প্রদর্শনী আধুনিককালে আমাদের শহরে বড়দিন উৎসব উৎযাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ যা কিনা বিগত কয়েকটি শতাব্দীতে বিশ্বে বিভিন্ন অঞ্চলে বড়দিনের অর্থনৈতিক প্রভাবটিকে ধীরে ধীরে প্রসারিত করেছে ।
ইতিহাস বিখ্যাত চিত্রশিল্পে যিশুর জন্মদৃশ্যটিতে মেরি, জোসেফ, শিশু যিশু, স্বর্গদূত, মেষপালক এবং যিশুর জন্মের পর বেথলেহেমের তারার সাহায্যে পথ চিনে তাঁকে দর্শন করতে আসা বালথাজার, মেলকোয়ার ও ক্যাসপার নামক তিন জ্ঞানী ব্যক্তির চরিত্র দেখা যায়।
পৃথিবীতে এসে মানুষের প্রতি এক অদ্ভুত ভালোবাসার দ্যুতি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই ভগবান যিশুর আগমন হয়েছিল !
আর বড়দিন বলতে ঈশ্বরের পুত্র ভগবান যিশুর পাশাপাশি আজকের পৃথিবীতে আরেকটি বহুল জনপ্রিয় চরিত্র “সান্টা দাদু”!
ছোটোদের বড়দিন মানেই সান্টাক্লজ(সান্টা দাদু), যার কাঁধে থাকে ঝোলা ভর্তি ব্যাগ, পরনে লাল রঙের পোশাকের পাশাপাশি মাথায় লাল টুপি, চোখে চশমা ও এক গাল সাদা দাঁড়ি । যিনি ছিলেন তুরস্কের পাতারা নামক অঞ্চলে জন্ম নেয়া সেইন্ট নিকোলাস নামের একজন সন্ন্যাসী, শিশুদের প্রতি পবিত্রতা ও উদারতার জন্য তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন ।
২৪ শে ডিসেম্বর গভীর রাতে থলে ভর্তি করে উপহার নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সান্টার দাদুর কাছ থেকে চকলেট ও উপহার যেন বাচ্চাদের জন্য দারুণ আনন্দের দিন…! আগের দিন রাতে বিছানায় ঘুমোতে যাওয়ার আগে দাদু সান্টার কাছে কি কি চাইবার চেয়ে টুপ করে ঘুমিয়ে পরে সকালে সেই গিফটের জন্য অপেক্ষা করা!
খ্রিষ্টীয় ধর্মের অন্তর্গত না হলেও সান্টা নামটি খুব গুরুত্বপূর্ণ “বড়দিন” এর উৎসবের সাথে!
২৪ শে ডিসেম্বর গভীর রাতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে নানা ধরনের উপহার দেওয়ার জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন ।
সান্টাকে নিয়ে বাচ্চাদের মনে মাতামাতির শেষ নেই । সান্টার বসবাস বরফে ঢাকা উত্তর মেরুতে!
১৮৮১ সালে থামস নামে একজন আমেরিকান কার্টুনিস্টের আঁকা ছবিতে ক্রিসমাসের সন্ধ্যাবেলায় নর্থ পোল থেকে আটটি বলগা হরিণ টানা স্লেজ গাড়িতে আকাশে চড়ে বাচ্চাদের বাড়ির চিমনি দিয়ে ঢুকে উপহার রেখে যেতেন সান্টা দাদু..!
পৃথিবীতে ভালোবাসার কথা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ইতিহাসের পাতায় কোন চরিত্রে সংখ্যার সীমাবদ্ধতা নেই।
একজন যীশু, যিনি তার যন্ত্রণাময় মৃত্যুতেও তার হত্যাকারীদের মানবিক ভালোবাসার কথা অকপটে বলে গেছেন রক্তাক্ত আহত ঠোঁটে…!
আরেকজন সাধারণ মানুষ সন্ন্যাসী
সেইন্ট নিকোলাস (সান্টা দাদু), মানুষের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসা ও শিশুদের পবিত্রতায় মানুষকে ভেদাভেদহীন ভালোবাসার বাঁধনের কথা রেখে গেছেন ইতিহাসের পাতায়।
আসলে সেইন্ট নিকোলাস (সান্টা দাদু) – কিংবা ঈশ্বর পুত্র যিশু…..
সব মিলিয়ে “বড়দিন” শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীর উৎসব নয়, এটি একটি ভালোবাসার দিনের গল্প..একটি সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখার গল্প।
সবাইকে বড়দিনে শুভেচ্ছা। ভালোবাসাই হোক পৃথিবীর একমাত্র অনুশাসন।
সৌগত রাণা কবিয়াল
(কবি সাহিত্যিক ও কলামিস্ট)