ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কছে এক স্বর্গ ভূমি লে-লাদাখ্‌।

0
291

ঘুরতে কে না ভালোবাসে। বিশেষ করে বাঙালিরা সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে ভ্রমনের নেশায়। কেউ পাহাড়, কেউ সমুদ্র আবার কেউ প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান ভালোবাসে ভ্রমণ করতে। প্রকৃতি কত কিছুই না আমাদের জন্য সাজিয়ে রেখেছে। কতটুকুই বা আমরা দেখেছি। এ বিশাল পৃথিবীতে আমরা অনেক কিছুই দেখিনি। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় আজ গোটা পৃথিবীটা হাতের মুঠোয়় এলেও প্রকৃতিকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করা এ এক আলাদা রোমাঞ্চ, আলাদা অনুভূতি যার রেষ হৃদয়ের মনিকোঠায় থেকে যায় চিরকাল।। তাইতো আজও মানুষ বেরিয়ে পড়়ে প্রকৃতির কে গায়ে মেখে  রোমাঞ্চিত হওয়ার নেশায়। কেউ চায় বিদেশে ভ্রমণে, আবার কেউ চায় দেশের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণে। এমনি এক ভ্রমণ এর জায়গা হলো  লে-লাদাখ্‌ ।

 

জন্মু ও কাশ্মীরকে আমরা ভারতের ভূস্বর্গ হিসাবে জানি । ভূস্বর্গ দর্শনের স্পৃহা অনেক দিনের । লে-লাদাখ্‌ ভ্রমণ ঐ স্পৃহারই  অন্যতম অঙ্গ ।
রাজ্যের একটি জেলা ছিল লে-লাদাখ্‌ ।  এখন লে-লাদাখ্‌ কেন্দ্রিয়শাসিত অঞ্চল । বর্গায়তনে হিসাব করলে লে-লাদাখ্‌ অনেক বড় । কিন্তু লোকসংখ্যার বসবাস খুব কম । সর্বসাকুল্যে আনুমানিক তিন-লক্ষ মানুষের বসবাস । স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়া প্রচুর সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনী কর্মরত । এছাড়া রয়েছে দেশী ও বিদেশী ভ্রমণ-পিপাসু মানুষের অহরহ আনাগোনা ।
লে-লাদাখের মানুষ ভীষণ গরীব । তাঁদের উপায়ের জায়গাটাও খুব নড়বড়ে । বলা চলে সীমিত । লে-লাদাখের জনবসতির ত্রিশ শতাংশ মানুষ ক্ষেতি জমির উপর নির্ভরশীল ।  ক্ষেতি জমি বলতে যব, জোয়ার, বাজরা, গম, চাষ । পাহাড়ি কোল ঘেঁষা  জমিতে চাষের দৃশ্য সর্বত্র । ঋতু অনুযায়ী বিভিন্ন চাষবাস । চাষের দৃশ্য নিঃসন্দেহে হৃদয়কাড়া । পয়ত্রিশ শতাংশ মানুষ রুটিরোজগারের জন্য পশুপালনের উপর নির্ভরশীল । পশুপালন বলতে লোমে ভরা ছাগল, গরু, ভেড়া, ইত্যাদি । আর অবশিষ্ট পয়ত্রিশ শতাংশ পর্যটকদের উপর নির্ভরশীল ।
বছরের প্রায় অর্ধেক সময় লে-লাদাখ্‌ বরফে ঢাকা থাকে । মে মাসের শেষে বরফ গলতে শুরু করে এবং সেই সময় থেকে বরফ সরিয়ে যাতায়াতের রাস্তা তৈরী করা শুরু  হয় । টুরিষ্টদের তখন মূলত লে-লাদাখের বিভিন্ন স্থানে ভ্রণের সুযোগ ঘটে । নভেম্বরের প্রথম  সপ্তাহ পর্যন্ত লে-লাদাখ্‌ ভ্রমণ চালু থাকে  !
স্থানীয় বাসিন্দারা প্রায় ছ-মাসের মতো জ্বালানী, খাবার এবং অন্যান্য নিত্য আবশ্যকীয় সামগ্রী মজুত রাখে । কেননা বরফ পড়ার সময় কোনো যানবাহন জোটে না । চুপচাপ নিজেদের এলাকার মধ্যে কাটাতে হয় । যারজন্য লে-লাদাখ্‌বাসীদের আগেভাগেই প্রয়োজনীয় খাবার, জ্বালানী, কাপড়-চোপড় ইত্যাদির ব্যবস্থা করাটা প্রত্যেকের কাছে একরকম বাধ্যতামূলক । জ্বালানী বলতে কাঠের টুকরো, ঘুটে (গোবর থেকে তৈরী), ইত্যাদি ।
সবচেয়ে দুঃখজনক, পুরো লে-লাদাখ্‌ এলাকা বাদ দিলে কোথাও বিশ্ববিদ্যালয় চোখে পড়েনি । বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে ছাত্র-ছাত্রীদের শ্রীনগর বা দেশের অন্যত্র শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে  যেতে হয় ।
দিল্লী থেকে খুব সকালের ফ্লাইটে লে । লে এয়ারপোর্ট খুব ছোট । পাশেই সামরিক ছাউনী । ফ্লাইট থেকে নামার সাথে সাথে ভীষণ দমকা হাওয়া ও কন্‌কনে ঠাণ্ডা । ফলে ঠাণ্ডা দমকা হাওয়া থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আশ্রয় নিতে হয়েছিল এয়ারপোর্টে পাশের অফিস ঘরে । একটা কথা প্রথমেই বলে রাখি, লে-লাদাখের চারিদিকে পাহাড় । তবে পাহাড়ের একটিই বৈশিষ্ট্য, পাহাড় গুলিতে কোনো সবুজ ঘাস নেই । ন্যাড়া । আর দিনের বেশীর ভাগ সময় পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফের আনাগোনা । যদিও ভোরবেলায় সাদা বরফের পরিমাণ বেশী ।
তারপর লে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল । হোটেলের নাম “গাওয়া লিঙ ইন্টারন্যাশনাল” । হোটেলে যাওয়ার পথে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়া । ফলে চারিদিকে কন্‌কনে শীতল ঠাণ্ডা । হোটেলে ঢুকেও ঠাণ্ডার হাত থেকে রেহাই নেই । সময়টা মে মাসের শেষদিক । নিজের রাজ্যের জেলায় প্রচণ্ড গরম । আর “লে”তে  সম্পূর্ণটাই উল্টো । হাড় হিম করা ঠাণ্ডা । বাইরে তাপমাত্রা মাইনাস ছয় । মাথার উপরে সূর্য আসার পর অল্প খানিকক্ষণের জন্য রৌদ্র । আকাশে রৌদ্র ওঠার পর লে’র অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য, মনকে খুশীর জোয়ারে ভরিয়ে দেয় ! তারপর দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজের পর “লে” মার্কেটে ঘরাঘুরি । উল্লেখ থাকে যে, ভ্রমণের উদ্দেশে পাহাড়ে ঘোরাঘুরির আগে একদিন বিশ্রাম নেওয়ার তাগিদে “লে”তে ঘুরে বেড়ানো । হোটেল থেকে হাঁটা পথে মার্কেট । তাই দুপুরে খাওয়ার পর “লে” মার্কেটে এবং আশপাশ অঞ্চলে ঘোরাঘুরি । সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে মানুষের আনাগোনা  কমে যায় । রাস্তাঘাট জনশূন্য হতে থাকে । হোটেলের পাশে কয়েকটি  ঝাউগাছ । ঝাউগাছ ভেদ করে দেখা যাচ্ছে ন্যাড়া পাহাড় ! পাহাড়ের মাথায় বরফ । রাত্রিতে দুটো লেপেও ঠাণ্ডা দমন করা কঠিন । এত ঠাণ্ডা,যাকে বলে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা  !
পরেরদিন কারুতে  (Karu) এলাম । কাছেই মিলিটারি স্টেশন । সেখানকার জওয়ানরা ভীষণ উপকাস্রী । কারুর কাছে পাহাড় ঘেঁষে জলাশয় । সেখান দিয়ে জল ছুটে চলেছে নীচের দিকে । তারপর এলাম ভগবান বুদ্ধের মন্দির “”হেমিস গোম্পা (HEMIS  GOMPA) । এখানে অনেক বৌদ্ধরা থাকেন । ভগবান বুদ্ধের সেবায় তাঁরা ব্রত । এখানে উল্লেখযোগ্য, লে-লাদাখে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা বেশী । “হেমিস গোম্পা”  লে-লাদাখে অন্যতম বৌদ্ধ-মন্দির । অল্প বয়সের বৌদ্ধরা মন্দিরে শাস্ত্র পাঠে তৎপর । বৌদ্ধ-ভিক্ষুরা পর্যটকদের সাথে মেলামেশায় যথেষ্ট আন্তরিক ! টুরিষ্টদের সমস্তরকম সহযোগিতায় তাঁরা যত্নবান ।
এবার আসছি তাংসি  (Tangtse) গাঁওয়ের কথায় । চতুর্দিকে পাহাড় । মধ্যেখানে জলাশয় । চারিদিকে অনেক গাঁও । তার পাশেই ক্ষেতি জমি । জলাশয়ের ধার ঘেঁষা রাস্তা । ঐ রাস্তা দিয়েই পৌঁছালাম তাংসি’তে । তাংসিতে একটা মজার ব্যাপার, কোনো টুরিষ্ট  রাত্রিযাপন করতে চাইলে জলাশইয়ের পাশে “তাঁবু”  খাটানোতে থাকতে পারে । তাঁবুতে থাকাটা একটা আলাদা অনুভূতির অভিজ্ঞতা । প্রচুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা তাংসি অঞ্চল । অন্যদিকে ঠাণ্ডা ততোধিক ! ।
বরফ কেটে রাস্তা । আমাদের সঙ্গে স্করপিয়ো গাড়ি । স্থানীয় ড্রাইভার । খুব গম্ভীর । ড্রাইভারের মুখে হাসি অধরা । আসলে তার ধাতে “হাসি” নেই । কিন্তু গাড়ি চালানোতে প্রচণ্ড শৃঙ্খলাপরায়ন । কোনো কথায় তার মনোযোগ নেই কোনোকথার উত্তর নেই । তার একটাই স্থির লক্ষ্য, বরফের পাশ দিয়ে খুব ধীরগতিতে অথচ সন্তর্পণে গাড়ি চালিয়ে খরদুংলা (khardung La) পৌঁছানো ।  যতদুর চোখ যায় শুধু সাদা বরফ । কোথায় নদী-নালা, কোথায় গাছ-পালা কিছুই বোঝার উপায় নেই । বরফাচ্ছন্ন খরদুংলা । পৃথিবীর সর্বোচ্চ মোটরগাড়ির রোড  (Highest Motorable Road) । ১৮৩৮০ ফুট উচ্চতা । খরদুংলা পৌঁছানোর সাথে সাথে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট । অত উঁচুতে শ্বাসকষ্টের সমস্যা । খরদুংলায় কোনো বসতি নেই । শুধুমাত্র ভারতীয় জওয়ানেরা কর্মরত । সেখানকার মিলিটারি ব্যারাকে কয়েকজন জওয়ান কর্তব্যরত । তাঁদের কাছে রয়েছে শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যার ক্ষেত্রে জরুরি গ্যাসের ব্যবস্থা । আমাদের সাথে একই লাইনে আরও কয়েকটা পর্যটকদের গাড়ি  খরদুংলা পৌঁছেছে । তাঁদের মধ্যে কয়েকজন পর্যটককে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়ার জন্য গ্যাসের প্রয়োজন । মিলিটারিরা দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে গ্যাসের সিলিণ্ডার নিয়ে সেইসব পর্যটকদের সেবা শুশ্রূষা করছেন । অন্যদিকে  আমি গাড়ি থেকে নেমে হাঁটাহাঁটি করার দরুন অনেকটা আরামবোধ করলাম । সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, একজন পরম হিতাকাক্ষ্মী মিলিটারি জওয়ান আমার অবস্থাটা অনুধাবন করে এক কাপ লিকার চা এগিয়ে ধরে  বিনীত স্বরে বললেন, “স্যার, এক কাপ লিকার চা খান । স্বাভাবিক সুস্থ বোধ করবেন ।“ খোঁজ নিয়ে জানলাম, জওয়ানের ঘর নদীয়া জেলার তেহট্টে ।  মিলিটারি ভদ্রলোকের দেওয়া চা খেয়ে সত্যিই অনেকটা হাল্কা বোধ করলাম । তারপর সমস্ত মিলিটারিদের উদ্দেশে স্যালুট জানালাম । এরপর খরদুংলা নিয়ে লেখা ( যেমন কত  মিটার উঁচু, জেলার নাম,  ইত্যাদি) পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ফটো তুললাম । সেখানেই লেখা রয়েছে খরদুংলা হচ্ছে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু মোটর যানের রোড, ১৮৩৮০ ফুট উচ্চতা ।
এরপর স্করপিয়ো গাড়ি ছুটলো নুব্রা (Nubra)  ভ্যালির দিকে । নুব্রা ভ্যালিতে যখন আমরা পৌঁছালাম, তখন সূর্য ডুবে গেছে । এখানে উল্লেখ করা প্রনিধানযোগ্য যে, নুব্রা একটা তহসিল  (Tehsil) । সেখানেই দিকসিত (Diksit)  গ্রাম । গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শায়ক (Shayok) নদী ।  দিকসিত গ্রামে সর্বসাকুল্যে এক হাজার মানুষের বসবাস এবং গোটা নুব্রা ভ্যালিতে বাইশ হাজার মানুষের বসবাস । নুব্রা ভ্যালিতে আরও একট জায়গা জনপ্রিয় গাঁও, তুরতুক । তুরতুকের কাছে টেগোর গ্রামে জামসখ্যাং নামে একট প্রাসাদ রয়েছে । তা ছাড়া নুব্রা ভ্যালি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর । তবে  এখানকার মানুষ খুব গরীব । নুব্রা ভ্যালিতে কৃষি ফসল বলতে গম আর বার্লি । নুব্রা ভ্যালির মানুষ মোমো খেতে ভালবাসেন । শিক্ষিত হওয়ার ক্ষেত্রে  কলেজ পর্যন্ত । নুব্রা ভ্যালিতে একমাত্র বালির দর্শন মেলে । চারিদিকে পাহাড় । মধ্যখানে মরুভূমি । মরুভূমি শুরু হওয়ার  মুখে জলের স্রোতে পা ভেজানোর মজাই আলাদা । মরুভূমির পাশেই শায়ক নদী । শায়ক নদী দিসকিত গ্রাম থেকে ১২ কিমি দূরে । ঐখানে “শায়ক” ও  “সিয়াচেন”  নদীর সংযোগস্থল । জায়গাটা আবার সিয়াচেন ও পাকিস্থানের কাছাকাছি । আগেই বলেছি নুব্রা ভ্যালির প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোমুগ্ধকর । আবার অন্যদিকে রাত্রির দিকসিত ভারী সুন্দর । বিজলী বাতি রয়েছে । বিজলী বাতি থাকলে কীহবে, একটু বাদে বাদেই লোডশেডিং । বিদ্যুতের টালবাহানায় স্থানীয় মানুষ নাজেহাল । অধিকাংশ  মানুষ বৌদ্ধ ধর্মালম্বী । এলাকার সর্বত্র মিলিটারিদের আনাগোনা । নুব্রা ভ্যালীর মানুষজন খুব পরিশ্রমী । আবার ততোধিক তাঁদের সরল জীবনযাপন । পরিবারের স্বামী-স্ত্রী উভয়েই উপার্জনের প্রতি ভীষণভাবে যত্নশীল ।
তারপর………?
তারপর  প্যাংগং লেক (Pangong Tso) । প্যাংগং লেক হিমালয়ের একটি এন্ডোরহেইক লেক বা হ্রদ (endorheic lake) ।  পৃথিবী বিখ্যাত এই  প্যাংগং লেক ।  লাদাখ্‌ ও চীনের রুতোগ প্রদেশের সীমান্তে ৪৩৫০ মি (১৪২৭০ ফুট) উচ্চতায় প্যাংগং লেক অবস্থিত । এই হ্রদ ১৩৪ কিমি লম্বা যার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ তিব্বতে অবস্থিত । এই লেকের পূর্ব দিকটা তিব্বতের অন্তর্গত ও পশ্চিম দিকটি ভারতের । লেকে যাওয়ার উদ্দেশে কিছু শুকনো খাবার এবং যথেষ্ট পরিমাণে খাবারের জল সঙ্গে নিলাম । নুব্রার হোটেল থেকে বলেই দিয়েছিল, রাস্তাঘাটে খাবারের দোকান নেই বললেই চলে । তবে ইদানীং কোথাও কোথাও দোকান চালু হয়েছে । যাই হোক এবার আসছি লেকের জল সম্বন্ধে । লেকের দিকে আমরা ধাবিত হওয়ার সময় গম্ভীর ড্রাইভার বলল, “চুপচাপ বসে থাকুন ।  রাস্তা ভীষণ ঝুঁকিবহুল । যেকোনো সময় ধস নামতে পারে ।  গাড়ির জানালা বন্ধ রাখা বাঞ্ছনীয় । কেননা ধস নামলে পাহাড়ের পাথরগুলি জানালা ভেদ করে শরীরে আঘাত করতে পারে । সুতরাং লেকে যাওয়ার  সফর খুব ঝুঁকিবহুল । গাড়ি চলাকালীন কেউ বেশী নড়াচড়া করবেন না ।“
অবশেষে আমাদের লক্ষ্য অনুযায়ী ঠিক সময়ে পৌঁছালাম প্যাংগং লেক । অনেক দূর প্যাংগং লেক । নুব্রা থেকে খালসার হয়ে প্যাংগং লেকের দূরত্ব প্রায় ৮৫ কিমি । পৌঁছানোর পর আমাদের মধ্যে সীমাহীন আনন্দ । আনন্দোচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা । প্রকৃতির অপূর্ব ভাণ্ডার ।  চারিদিকে পাহাড় । পাহাড়ে সবুজের লেশমাত্র নেই । উপরে রৌদ্রোজ্জ্বল  নীল আকাশ । ঝকঝকে নীল আকাশে খণ্ড খণ্ড,  টুকরো টুকরো সাদা মেঘ ।  নীচে লেক । লেকের জলও তেমনি । সমুদ্র-নীল জল ।  জলের রঙ একেক সময় বা একেক জায়গায় একেক রকম ! সারা লেকে আছে শুধু রঙের বৈচিত্র !  রঙিন জল দেখতে ভীষণ সুন্দর । লেকের জল দেখে প্রাণ জুড়ে যায় । শোনা যায়, অনেক সিনেমার স্যুটিং নাকি লেকের ধারে হয়েছে । তার মধ্যে থ্রি-ইডিয়েট অন্যতম । তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা অভিনব । রাত্রিতে আমাদের থাকার কোনো পরিকল্পনা না থাকায় আমরা ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করলাম ।  সন্ধ্যার আগে ফেরার তাগাদা । যদিও সন্ধ্যার সময় লেকের ভিউ অন্যরকম । তাঁবুতে যারা রাত্রিযাপন করবেন, তাঁদের পক্ষে লেকের রাত্রির শোভা দর্শন যথেষ্ট আনন্দের । কিন্তু আমাদের সন্ধ্যা নামার আগে লেক থেকে বিদায় নিতে হবে । সূর্য অস্ত যাওয়ার মনোরম দৃশ্য দেখে আমরা অভিভূত । তারপর মন না চাইলেও বিপদের সম্ভাবনাকে দূরে রাখার জন্য আমরা সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেরার উদ্দেশে রওনা দিলাম ।
ফেরবার পথে পৌঁছালাম চ্যাংলা Chang La)  । চ্যাংলার উচ্চতা ১৭৬৮৮ ফুট । পৃথিবীতে দ্বিতীয় মোটর যানের রোড হিসাবে চ্যাংলা’কে দাবি করা হয় । সেখানে একমাত্র কয়েকটি মিলিটারি ক্যাম্প ছাড়া মানুষজন, দোকানপাট  চোখে পড়ল না  ।  আছে শুধু পাগল করা মন-মাতানো সাদা বরফ । আর সর্বক্ষণ মনে হচ্ছে মাথার উপরের আকাশটা অনেক কাছে ।  সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, সেটা হচ্ছে পর্যটকদের নির্বিঘ্নে ভ্রমণে মিলিটারিদের তৎপরতা !
এই প্রসঙ্গে আরও উল্লেখযোগ্য,  কারু (Karu) মিলিটারি জওয়ানদের ব্যবহার !  এক কথায়, অতি উত্তম । নিঃসন্দেহে অতুলনীয় । কারু শহরে পুরোটাই গরীব মানুষের এলাকা । কারু শহরে এছাড়া শান্তি স্তুপো বৌদ্ধ মন্দিরে ও থিক্সে  (Thiksay) মোনাস্টারিতে ভ্রমণ অবর্ণনীয় ।
ফিরে এলাম “লে” মার্কেটে । স্থানীয় মোমো খাবার ভীষণ জনপ্রিয় । যব, বাজরা, গম, ইত্যাদি দিয়ে স্থানীয় খাবার তৈরীর প্রক্রিয়াটা অন্যরকম । তাঁরা বাঙালীদের মতো ভেতো বাঙালী নয় । তাঁদের খুব সাদাসিধে জীবন । শিক্ষার হার খুব কম । স্বাস্থ্য ব্যবস্থা  তথৈবচ । পুরো “লে”-“লাদাখে” সরকারি স্তরের দৃষ্টিভঙ্গি আশু প্রয়োজন ।

সংক্ষেপে লে-লাদাখ্‌ এই  পর্যন্ত ।

কলমে : দিলীপ রায়
—————-০—————–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here