১৮৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি। আজকেই সেই দিন। যাঁর ইচ্ছেয় এই সংসারে আসা, যাঁকে পাওয়ার জন্যে এই সংসারে আসা- সেই তাঁর কাছে সবটা পাওয়ার দিন। কল্পতরু। পুরাণ বলবে সমুদ্রমন্থনে পাওয়া এক দিব্য বৃক্ষ এই ‘কল্পতরু’। দুধের সাগর মন্থন করতে করতে ‘কামধেনু’র মতোই উঠে এলো কল্পতরু, কল্পবৃক্ষ বা কল্পদ্রুম। তার নিচে দাঁড়িয়ে যাই চাইবে তাই পাওয়া যাবে। কিন্তু, কতদূর চাইব তার কাছে? কামিনী-কাঞ্চন? তারপর? সবই তো আগুনে ঘি দেওয়ার মতো। বাসনা যেন আগুন আর বাসনা-পূরণ ঘি। অনল তো জ্বলতেই থাকবে। এর শেষ কোথায়? যা পাওয়া হলে তারপর আর চাওয়ার কিছু থাকবে না, তা মিলবে? আপনিই একাধিকবার মনে পড়িয়ে দিয়েছিলেন গল্পের ছলে। পথে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একটি লোক একটি গাছের নিচে আশ্রয় নিলেন। গাছটি যে কল্পতরু তা লোকটি জানতেন না। হঠাৎ তার মনে হল, ‘”তেষ্টা পেয়েছে, একটু যদি জল পেতাম তো খুব ভাল হত।’’ যেই না ভাবা সেই নানা রকম জল এসে হাজির। এরপর তার মনে হল, ‘‘একটু খাবার পেলে বেশ হত।’’ তখনই লোভনীয় নানা খাবার উপস্থিত। বিশ্রামের কথা মাথায় আসতেই অমনি সুন্দর শয্যা প্রস্তুত। এ বার তিনি ভাবলেন, ‘‘যদি কেউ একটু পা টিপে দিত, ঘুমটি বেশ ভাল হত।’’ এক সুন্দরী মহিলা সাথে সাথে উপস্থিত। হঠাৎ তাঁর মনে হল, ‘‘এত সুখ আমার কপালে সইবে তো? হঠাৎ যদি বাঘ এসে হাজির হয়!’’ ভাবা মাত্র বাঘ এসে হাজির হয়ে লোকটিকে খেয়ে ফেলল। কল্পতরুর কাছে জাগতিক কামনার জিনিস চাইতে গেলেই সাথে সাথে বাঘটিও এসে পড়ে, এই হল সমস্যা। পুরাণ যাই বলুক, ঠাকুর! আপনার ভক্তেরা জানে, এই সংসারে ঠিক ঠিক ‘কল্পবৃক্ষ’ বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তা একমাত্র আপনি। আর কেউ নন।
কতবার কতরূপে আপনার এখানে আগমন। কত কত লীলা! কখনও হাতে ধনুর্ব্বাণ নিয়ে সেই একাকী পুরুষ। কখনও বাঁশি হাতে গোঠের রাখাল। আবার কখনও প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে উদ্বাহু নৃত্যে মধু বিলিয়েছেন, এই বাংলার নরম মাটিতে। কিন্তু, প্রভু! এইবার এ কী বেশ আপনার! এ যেন সবটা একসাথে, এক দেহে সব যুগের সব লীলা ধারণ করেছেন। আপনার প্রিয় নরেন তাই বিবেকানন্দ হয়ে গেয়ে উঠবেন, ‘অবতার বরিষ্ঠায়’।
আপনি বার বার বলেছেন, কারোর ভাব নষ্ট করতে নেই। আপনি এও বলেছেন, যে যেই ভাবে ভগবানকে ডাকে সে সেই ভাবে পায়। একই পুকুরের জল। কেউ বলছে ‘পানি’, কেউ বলছে ‘ওয়াটার’ আবার কেউ বলছে ‘অ্যাকোয়া’। কিন্তু, তৃষ্ণা সবার মিটছে। বাড়িতে মাছ রান্না হলে মা কারোর জন্য ঝোল রেঁধে দেন, কারোর জন্য ঝাল আবার কারোর জন্য অম্বল। যার পেটে যা সয়। সবাইকে নিজের নিজের ভাবের পথে হাত ধরে এগিয়ে দিতেই কি আপনি এতো রকম সাধন করলেন? বেশিরভাগ গাছে আগে ফুল হয়, পরে তা থেকে ফল। তবে, কুমড়ো-লাউ ইত্যাদিতে আগে ফল আসে, পরে আবার ফুল দেখা যায়। ইষ্টের দেখা তো আপনি পেয়েই গেছিলেন। তারপরেও ভৈরবীর হাত ধরে নিলেন তন্ত্রের পাঠ। সিদ্ধিলাভ করলেন। তোতাপুরীর কাছে নিলেন বেদান্তের অদ্বৈত ভাবের দীক্ষা। নির্বিকল্প সমাধি লাভ করলেন। বৈষ্ণবীয় ভক্তিশাস্ত্রের শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর – একে একে এই সবকটি ভাব পূর্ণতা পেল আপনার তীর্থসম দেহভান্ডে। ইসলামের সাধনা করলেন। খ্রীষ্টমতেও সাধনা করে দেখলেন। সমস্ত সাধনমার্গের চরমতম অনুভূতি লাভ করে বললেন, যতো মত, ততো পথ। পরবর্তীকালে এইসব নানারকম ভাবধারার ভিন্ন ভিন্ন সাধকগণ সাধনপথের মধ্যে বাধার সম্মুখীন হয়ে, সাহায্য পেতে আপনার কাছে এসেছেন। বলাই বাহুল্য, শ্রীভগবানের দুয়ারে হাত পেতে কেউই ফিরে যাননি।
অন্যান্য আর-চার পাঁচটা যুবকের মতো আপনার কাছে নরেনও আসতেন। আপনি বলতেন, কেউ দশ, কেউ পনের, কেউ বড়জোর বিশদল বিশিষ্ট পদ্ম। কিন্তু, নরেন যে সহস্রদল কমল। ইংরেজি পড়া, দর্শনে চৌকস নরেন্দ্র নাথ দত্ত তখন ‘ঈশ্বর কি’ এই অনুসন্ধানে মত্ত। এর কাছে যান, তার কাছে যান, কিন্তু, যুবক নরেন্দ্র’র মনের সন্দেহ দূর করতে পারেন না কেউ। আপনার সামনে এসে নরেন্দ্র আপনাকেও জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ঈশ্বরকে দেখেছেন? আপনি রাখঢাক না রেখে বললেন, তোকে যেভাবে দেখছি সেভাবে দেখেছি। এই প্রথম কেউ হেঁয়ালি না করে নরেন্দ্র’র প্রশ্নের উত্তর দিলেন। নরেন্দ্র’র তবু সন্দেহ দূর হয় না। নারদীয় ভক্তিসূত্রে বলছে, অবতারগণ স্পর্শ করে লোকের চৈতন্য সম্পাদন করেন। অতঃপর একদিন আপনার পবিত্র স্পর্শে নরেন্দ্র’র চোখের সামনের বিশ্ব-সংসার নিমেশে উধাও হয়ে গেল। চতুর্দ্দিকে অন্ধকার; অন্ধকারের আলো। আনন্দ স্রোতের খেলা দেখতে পেলেন নরেন্দ্র ভুবনময়। অতীন্দ্রিয় জগত থেকে আপনি আবার তাঁকে সংসারে ফিরিয়ে আনলেন। তাঁর যে এখনও অনেক কাজ বাকি। সে নিজে মুক্ত হলেই তো আর হবে না। তাঁকে যে মুক্ত করতে হবে আরও লক্ষ্য লক্ষ্য মুমুক্ষু জীবকে। ছড়িয়ে দিতে হবে আপনার বাণী ও আদর্শ।
বাংলার রঙ্গমঞ্চের মুকুটহীন সম্রাট গিরিশ ঘোষ আপনার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে জানতে চেয়েছিলেন, এখন থেকে আমি কি করব ঠাকুর? সংসারের বিশাল দহে তিনি নিমজ্জিত। আপনি বললেন, এক হাতে সংসার, আর হাতে ঈশ্বর ধরে রাখতে। কিন্তু, দু’বেলা নামগান করার সময় তাঁর নেই। আপনি বললেন, ঘুমনোর আগে একবার তাঁকে ডাকবি। তবু গিরিশের মনে সংশয়। পাছে গুরুকে কথা দিয়ে কথার খেলাপ হয়। আপনি তখন তাঁকে বললেন, বেশ। তবে আমাকে বকলমা দে। গিরিশ আশ্বস্ত হলেন। তিনি বুঝলেন, নিজের চেষ্টায় সাধন-ভজনে তাঁকে কিছু করতে হবে না। পরমহংস স্বয়ং নিজের কৃপাবলে তাঁকে উদ্ধার করবেন। বাঁধন অসহ্য মনে হতো গিরিশ ঘোষের। সেই গিরিশ তখনও বোঝেন নি, নিয়মের বাঁধন এড়াতে কী ভয়ানক প্রেমের বাঁধন গলায় পরেছেন তিনি!
এর পর থেকে জীবনের প্রতি মুহুর্তে তিনি আপনার কৃপা দর্শন করতে লাগলেন। শত লাঞ্ছনাতেও মনে হতে লাগল, যে যাই বলুক আমার তো ঠাকুর আছে। তিনি তো আমাকে আপনার করে নিয়েছেন। গিরিশ বুঝতেও পারলেন না, তাঁরই অজ্ঞাতসারে আপনি প্রতি মুহুর্তে তাঁকে দিয়ে আপনার ধ্যান করিয়ে নিচ্ছেন। কালের গর্ভের সকলই আপনি জ্ঞাত আছেন, মধুসূদন! এরপর যখন গিরিশের স্ত্রী-পুত্র বিয়োগ ঘটবে তখনও তিনি তা নিয়ে কোনও অভিযোগ করবেন না আপনার কাছে। তিনি মনে মনে জানবেন, আমি তো ঠাকুরকে সব বকলমা দিয়েছি। তিনি আমাকে মঙ্গলপথে নিয়ে চলেছেন। যে ভাবেই তিনি নিয়ে চলুন, মেনে নিতে হবে। ইন্দ্রিয়ের আনন্দ উৎপাদন করেন বলে, আপনার আরেক নাম গোবিন্দ। গিরিশও এবার থেকে সমস্ত সুখে-দুখে, জয়-পরাজয়ে শুধু আপনার অনুভব স্বরূপ আনন্দ উপলব্ধি করবেন। কালে কালে গিরিশ বুঝতে পারবেন, স্বয়ং ভগবানকে বকলমা দেওয়ার গভীরতা। জপ-তপ জাতীয় কর্মের তাও তো একটা শেষ আছে। আপনাকে বকলমা দিলে সেই কর্মের তো আর শেষ নেই। প্রতি নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে ধ্যান করতে হয়। সংসারে আবদ্ধ জীবকে আপনার মতোন করে আর কে করুণা করবে, প্রভু?
আপনার গলায় দুরারোগ্য ক্যানসার। প্রায় বছর খানেক ধরে এ রোগ আপনার দেহকে জীর্ণ করে দিয়েছে। চিকিৎসার সুবিধার জন্য কাশীপুর উদ্যানবাটিতে আপনাকে এনে রাখা হয়েছে। ১লা জানুয়ারি আপনি একটু সুস্থ্য বোধ করছেন। বাগানে হাঁটতে বেরিয়েছেন। সাথে ভক্তেরা। এমন সময় গিরিশকে আপনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি মনে হয়? আমি কে?
গিরিশের স্থির বিশ্বাসী কন্ঠ, আপনি ঈশ্বরের অবতার। ব্যাস যার কথা বলে শেষ করতে পারেন নি, তাঁর কথা আমি কি বলব?
ঠিক এ সময় ভক্তকুলের মাঝে “তোমাদের চৈতন্য হোক” বলে সমাধিস্থ হলেন আপনি। আপনার মুখ উদ্ভাসিত। সারা বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের অনির্ব্বচনীয় জ্যোতি সে মুখে। দেখে কে বলবে এ সেই দীর্ঘকাল কর্কট রোগে আক্রান্ত শরীর! সন্ন্যাসী শিষ্যরা সেদিন নেই। সংসারী শিষ্যরা অহৈতুকী কৃপাপরায়ণ ভগবানকে সচক্ষে দর্শন করছেন। সমাধিস্থ মুখে আপনার স্মিত হাসি যেন ঘোষণা করছে, আপনিই সেই। শ্রীমদ্ভাগবতগীতার সেই অঙ্গীকার ভক্তেরা যেন পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছেন,
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ৷৷
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ৷৷
ভক্তেরা আপনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে নিচ্ছেন। চেয়ে নিচ্ছেন যার যা মনোষ্কাম। হ্যাঁ! আপনার চেয়েও আপনার যে জন, তাঁর কাছেই তো চাওয়া যায়। আপনিই বলেছেন, যেন নিজের বাবা। যেন নিজের মা। তিনি তো আপনার লোক। তাঁর কাছে জোর চলে। আপনার শিষ্য শ্রী রামচন্দ্র দত্ত শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা করে বললেন, ঠাকুর কল্পতরু হয়েছেন। দিনটাকে ‘কল্পতরু দিবস’ নামে ডাকা হল। বছর বছর এই দিনটিতে কাশীপুর উদ্যানবাটীর পাশাপাশি দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির এবং অন্যান্য স্থানে আপনার দেশ-বিদেশের ভক্তেরা আসতে শুরু করবে অচিরেই। আপনার দ্বারে ভিড় ক্রমশঃ বেড়েই যাবে। কল্পতরু বৃক্ষতলে আশ্রয় খুঁজবে সংসারের দাবদাহে তপ্ত পথিককুল। ‘কল্পতরু দিবস’ হয়ে উঠবে আশ্রয়ের উৎসব।
[প্রাবন্ধিক অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায় ডাঃ বি.সি. রায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সহকারী অধ্যাপক। অধ্যাপনার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চার নেশা। প্রবন্ধ ছাড়াও গল্প এবং কবিতার জগতও তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘সলতে’ (বইতরণী প্রকাশনী), ‘আমাদের পঞ্চম’কার সাধন’ (ঋতভাষ প্রকাশনী), ‘পিওনি ফুলের বিপরীতে’ (কবিতা আশ্রম প্রকাশনী)। সুরজিত ও বন্ধুরা কবিতা ক্লাব থেকে পেয়েছেন ‘কলমকার’ সম্মাননা। রাজ্য যুব ও ক্রীড়া দফতর থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন ছোটগল্পকার হিসেবে।]
ই-মেইল- sahityik.arka@gmail.com
Leave a Reply