পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় ভ্রমণ।

0
170

ভ্রমণের ব্যবহারিক অর্থ নানানরকম । যেমন প্রাতকালীন ভ্রমণ, বৈকালিন ভ্রমণ, নদীর পারে ভ্রমণ, জ্যোৎস্নার আলোয় ভ্রমণ, ট্রেনে-বাসে-উড়োজাহাজে-জলযানে ভ্রমণ, নৌকায় ভ্রমণ,  ইত্যাদি । আক্ষরিক অর্থে আমরা যেটা বুঝি ভ্রমণ অর্থ বেড়ানো, ঘোরাঘুরি, এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়া, অর্থাৎ  পর্যটন করা । অন্য অর্থে  দেশের  বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ, বিদেশ ভ্রমণ, ইত্যাদি । এছাড়া ভ্রমণ অর্থ যেটা বুঝি, সেটা হচ্ছে চিত্তবিনোদন, পর্যটন ও অবকাশ যাপন ।  ভ্রমণ মানুষের জীবনে আনে বৃহত্তের আহ্বান । আনে অজানা সৌন্দর্যের সংবাদ । অচেনার সান্ন্যিধে মানুষ পায় বিষ্ময়ের অনুভূতি । তাই ভ্রমণ শুধুমাত্র দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিদেশ ভ্রমণও সমানভাবে উল্লেখযোগ্য । তবে এটাও ঘটনা, মানুষের মধ্যে ভ্রমণের আবশ্যিক দিক নিজের দেশকে জানবার, বোঝবার, দেখার । নিজের জন্মস্থানের গাঁ-গঞ্জ-শহর-নগর থেকে বেরিয়ে দেশের ও বিদেশের অন্যত্র ভ্রমণের মাধ্যমে জানাটা ভ্রমণের মুখ্য উদ্দেশ্য ।  তা ছাড়া দিনের পর দিন একই পরিবেশের জীবন যাপন থেকে ক্ষণিকের মুক্তি । একটু বৈচিত্রের আস্বাদনের উপলব্ধি, যে বৈচিত্র আমাদের দেয় অপরিসীম আনন্দ ।
এই ভূখণ্ডকে জানবার জন্য প্রয়োজন দেশ ভ্রমণ । ইতিহাস ও ভুগোলের বাইরে অবাধ উন্মুক্ত খোলা আকাশের নীচে জীবন্ত দেশটি দেখে, তার অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ স্পর্শ লাভ করে, তাদের জীবনধারা সম্পর্কে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি, সেই জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান । হৃদয়ের প্রসারতা ও মনের গতি আনে ভ্রমণ । ভ্রমণে শরীরকে রাখে তরতাজা । মনের আঙ্গিকে পাওয়া যায় পরিতৃপ্তির চরম আস্বাদন ! সেই নিরিখে ঘোরাঘুরি-বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানো, আমাদের জীবনের একটা  অপরিহার্য অঙ্গ ধরে নিতে পারেন । এবার গন্তব্য — পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় । অযোধ্যা পাহাড় ছোটনাগপুরের মালভূমির  পূবদিকের অংশ এবং পুরুলিয়ার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র । এটি দলমা পাহাড়ের একটি অংশ এবং পূর্বঘাট পর্বতমালার সম্প্রসারিত অংশ । বাঘমুন্ডি হচ্ছে পাহাড়ের কাছের শহর । বাঘমুন্ডি বা অযোধ্যা পাহাড়ের আশেপাশের অঞ্চলটি হচ্ছে একটি সম্প্রসারিত মালভূমি ।  অযোধ্যা পাহাড়ের উচ্চতম শৃঙ্গটি হলো গোরগাবুরু । অযোধ্যা পাহাড়ের গড় উচ্চতা প্রায় ২০০০ফুট এবং পাহাড়ের মাথাটি হিলটপ নামে খ্যাত ।

               ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি আমাদের যাত্রা শুরু ।  নিজের গাড়ি ।  বর্ধমান, দুর্গাপুর পার হয়ে রানীগঞ্জ শহরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম । ড্রাইভার বলল, রানীগঞ্জ হয়ে পুরুলিয়া শহরে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যাবে । আমরা কর্তা-গিন্নি ড্রাইভারের  কথায় আশ্বস্থ হয়ে গাড়িতে বসে রইলাম । রানীগঞ্জ শহরের ভিতরে পুরানো আমলের ছোট রাস্তা । তার উপর সান্ধ্যকালীন জমজমাট বাজার ! দুইদিকে রাস্তা ঘেঁষে দোকান । তার মধ্যে খুচরো ব্যবসায়ীরা ডালায় বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে খরিদ্দার ধরতে ব্যস্ত । অতি   কষ্টে অনেক সময় অতিবাহিত করে আমরা রানীগঞ্জ ছেড়ে মেজিয়ার দিকে এগোতে লাগলাম । তখন রাত্রির অন্ধকার জাঁকিয়ে বসেছে । গাড়ি চালানোর কায়দা-কানুন দেখে বোঝা গেলো, ড্রাইভার এলাকা সম্বন্ধে ততটা সড়গড়  নয় । তাই বাধ্য হয়ে রাস্তায় পথ চলতি মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করে আমরা এগোতে থাকলাম । মেজিয়া পার হয়ে গাড়ি ছুটল শালতোরার দিকে । শালতোরা একটি পুরানো ছোট্ট শহর । শালতোরার আশেপাশে অনেক গ্রাম । গ্রামগুলি খুব বর্ধিষ্ণু ও পুরানো । যেটা বোঝা গেলো, চাষবাস এলাকার মানুষের মুখ্য জীবিকা ।  তারপর গাড়ি ছুটলো রঘুনাথপুরের দিকে । রঘুনাথপুরে যাওয়ার রাস্তাটাও সেভাবে চেনা নয় । তাই  কখনও অন্য গাড়ি দাঁড় করিয়ে অথবা রাস্তার পাশের দোকানে জিজ্ঞাসা করে আমাদের গাড়ি এগোতে লাগলো । পুরুলিয়া জেলার অন্যতম শহর রঘুনাথপুর । রঘুনাথপুর পৌঁছানোর পর জানা গেলো, পুরুলিয়া শহর অনেক দূর । পৌঁছাতে প্রায় এক ঘন্টা । তারপর পুরুলিয়া শহর থেকে সিরকাবাদ পৌঁছাতেও অনেক সময় দরকার । আমাদের টার্গেট সিরকাবাদ থেকে অযোধ্যা পাহাড়ে ওঠা ।  যেমন শিলিগুড়ি থেকে  দার্জিলিং  পৌঁছানো, কোয়েম্বাতোর থেকে উটি (ooty) যাওয়া, ইত্যাদি । অযোধ্যা পাহাড়ে হোটেল বুকিং অনেক আগেই করা  । তবুও রঘুনাথপুর ছাড়ার ঠিক পরেই হোটেল থেকে ফোন, আমরা অযোধ্যা পাহাড়ে কখন পৌঁচ্ছাছি, কী খাবার খাবো, ইত্যাদি  ?                  ঘটনাচক্রে আমার একজন সাহিত্যিক বন্ধু নীরোদ দত্ত সিরকাবাদের স্থায়ী বাসিন্দা । রঘুনাথপুর ছাড়ার পর থেকেই তিনি আমাদের ঠিকমতো পথ নির্দেশ করতে লাগলেন এবং ধীরে সুস্থে গাড়ি চালাতে বললেন । পাহাড়ে হোটেলে থাকার ব্যাপারে অযথা চিন্তা করতে না করলেন । কারণ ঐ হোটেলের মালিক তাঁর পরিচিত । তাই তিনি হোটেলের মালিককে বলে রাখলেন এবং আমাদের বললেন, বেশী রাত্রিতে পৌঁছালেও খাবার রেডি থাকবে ।
নীরোদবাবু বললেন, পুরুলিয়া পৌঁছে তাঁকে জানাতে । কেননা পুরুলিয়া থেকে সিরকাবাদ যাওয়াটা একটু ভজঘট । পুরুলিয়া শহরে পৌঁছালে তিনি আবার বলে দেবেন আমরা কোন্‌ রাস্তা ধরে সিরকাবাদ দ্রুত পৌঁছানো যাবে । সেই মোতাবেক আমরা পুরুলিয়া  পৌঁছে নীরোদবাবুকে ফোন । তিনি বললেন, পুরুলিয়া শহর ছাড়লে প্রথমে টামনা মোড় । টামনা মোড় থেকে ডান-দিকের রাস্তা ধরে সোজা আহাড়রা মোড় পৌঁছাতে হবে । টামনা মোড় থেকে রাস্তাটা গিয়েছে আড়শা পর্যন্ত । আড়শা একটা ব্লক টাউন । তার কিছুটা আগে আহাড়রা মোড় । রাতের অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলছে । আমাদের ও ড্রাইভারের পুরোপুরি অচেনা জায়গা । রাস্তার দুধারে গাছ-গাছালিতে ভর্তি । রাতের অন্ধকারে ক্ষেতি জমির চাষবাস বোঝা যাচ্ছে না । পুরোটাই পুরুলিয়ার আদিবাসী গ্রাম । যাই হোক আর একটুই হলেই আমরা আহাড়রা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম । গিন্নির আওয়াজে জায়গাটা সনাক্ত করা গেলো । তারপর কিছুটা পেছনে ফিরে আহাড়রা মোড় থেকে সিরকাবাদের দিকে রওনা দিলাম । নীরোদবাবু হাসপাতাল মোড়ে দাঁড়িয়ে । তাঁর নির্দেশ মতো আহাড়রা মোড় থেকে তিন কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে আমরা সিরকাবাদের হাসপাতাল মোড় পর্যন্ত পৌঁছালাম । নীরোদবাবু  সেখানকার কয়েকজন  মানুষকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন । রাত্রি তখন দশটা । নিঝুম এলাকা । চায়ের দোকান খোলা ।   গাড়ি থেকে নেমে নীরোদবাবুদের সঙ্গে কুশল বিনিময় । তারপর চা-পর্ব  । চা খাওয়ার পর আবার গাড়িতে । সিরকাবাদ থেকে তেরো কিলোমিটার পাহাড়ে ওঠা । নোরোদবাবু বললেন, ভয়ের কারণ নেই । রাস্তাঘাট পরিষ্কার । নির্ঝঞ্ঝাট রাস্তা । নীরোদবাবুদের বিদায় দিয়ে আমরা অযোধ্যা পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম ।  যখন পাহাড়ে পৌঁছালাম, রাত্রি তখন এগারোটা । হোটেলে ঢুকে ফ্রেস হয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম । পরেরদিন পাহাড়ের দ্রষ্টব্যস্থানগুলিতে ভ্রমণ ।


( ২ )
সকালবেলায় হাল্কা স্নাক্সের সাথে কফি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ।   হোটেল থেকে বের হওয়ার আগে হোটেলের ম্যানেজারের সাথে আলোচনা করে দর্শনীয় স্থানগুলি সম্বন্ধে একটা ধারণা নিলাম । তারপর ঠিক করলাম,  দূরের মুরগুমা ড্যামে প্রথমে যাবো । সেই মোতাবেক সোজা মুরগুমা ড্যামের দিকে গাড়ি ছুটলো । যাওয়ার পথে পড়লো সুসাইড পয়েন্ট । চারিদিকে সবুজের সমারোহ । প্রকৃতির এত সুন্দর রূপ রুক্ষ্ম পুরুলিয়ায় বিরল । চোখ জুড়িয়ে যাওয়া প্রকৃতির সবুজ দৃশ্য ! মোটর সাইকেলে একজন চায়ের দোকানদার সুসাইড পয়েন্টে নেমে চায়ের দোকান সাজাতে ব্যস্ত । অল্প বয়সী দোকানদার বলল,  সুসাইড পয়েন্টে এখন দেখার মতো কিছু নেই । বন জঙ্গলে ভরে গেছে । তবুও সুসাইডের জায়গাটা দেখালো বটে তাতে অভিনবত্ব কিছু নেই । পুনরায় আমরা যাত্রা শুরু করলাম । “মুরগুমা ড্যাম”  এলাকা তথা পুরুলিয়া জেলার মধ্যে নামকরা ড্যাম ।  বিশাল এলাকা জুড়ে জলাশয়  । জলাশয়ের জলে রঙ বদলের খেলা । কখনও সবুজ, কখনও নীল, আবার কোথাও রোদের ঝিকিমিকি !  পাশের বসবাসরত মানুষেরা ড্যামে এসে স্নান সারছেন । বিশেষ করে মহিলাদের সংখ্যা বেশী । এখানে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ সংখ্যাধিক্য । ক্ষেতি জমিতে স্থানীয় মানুষের চাষবাস ।  কিছু আদিবাসী মানুষ বন-জঙ্গল থেকে গাছের পাতা কেটে বাড়ি ফিরছিলো । “পাতা কেন সংগ্রহ করা হচ্ছে ?” — জিজ্ঞাসা করতেই তারা বলল, গরুর খাবারের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । জলাশয়টিতে নৌকা-বিহারের ব্যবস্থা করলে ভ্রমণপিপাসু মানুষের আকর্ষণ আরও বাড়ত । তবে স্থানীয় মানুষ  মুরগুমা ড্যামে জল সঞ্চয় করে সাধারণত জমি চাষের জন্য ।  মুরগুমা বাঁধ ঘোরার পর আবার অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে ছুটলাম । কেননা  ময়ুর পাহাড়  অযোধ্যা হিল ঘেঁষা । এবার ময়ূর পাহাড় দর্শনের পালা ! ময়ূর পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় হনুমান মন্দির । সেখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার অতি উত্তম জায়গা । অনেকটা উঁচু । অনেক ভ্রমণ পিপাসু মানুষ  পরিশ্রান্ত হওয়ার কারণে  হনুমান  মন্দিরে পৌঁছানোর আগেই থেমে যান ।  ময়ূর পাহাড়ে ওঠার সময় দুপাশে অনেক আদিবাসী ছেলেমেয়েদের ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘোরাফেরা । পর্যটকেরা যে যেভাবে পারছে তাদের পয়সা, খাবার দিয়ে সহায়তা করছেন । ময়ূর পাহাড় থেকে নেমে এসে আমাদের গন্তব্য আপার ড্যাম ও লোয়ার ড্যাম ।
আপার ড্যামের বিশেষত্ব হলো, ড্যামে জল সঞ্চয় করা । সেই জল টারবাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরী  । তারপর জল লোয়ার ড্যামে পৌঁছে যায় । চারিদিকে পুলিশি সতর্কতা । অনেকে আপার ড্যামে পিকনিক করতেও যায় । আপার ড্যামের রাস্তার উপরে মোটর বাইকে ঝাল-মুড়ি অবাধে  বিক্রি হচ্ছে । মাখানো ঝাল-মুড়ির অপূর্ব স্বাদ !  তা ছাড়া আপার ড্যাম থেকে অযোধ্যা পাহাড়টাকে সুন্দর দেখা যায়  ।
লোয়ার ড্যাম,  সানসেটের জন্য খুবই মনোরম  । লোয়ার ড্যামের  পিছনের পাহাড় উঠে গেছে আপার ড্যাম পর্যন্ত । ঝিলের মধ্যে সূর্যের আলো জলের সাথে খেলা করে । লোয়ার ড্যামের আশেপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য বড় সুমধুর । সবুজ পাহাড় ঘিরে থাকা এই লোয়ার ড্যাম ।  বিভিন্ন রকম গাছ-গাছালিতে ভরা ।

ঘুরে এলাম লহরিয়া ড্যাম । এখানে প্রসিদ্ধ শিব মন্দির রয়েছে । সামনের বিশাল জলধারাটি দেখার মতো । এখানে পিকনিক বেশী হয় । এইজন্য লহরিয়াকে অনেকেই পিকনিক স্পট হিসাবে জানে । তবে চারিদিকের প্রাকৃতিক পরিবেশ স্নিগ্ধ ও শীতল । জায়গাটা খুব ভাল লাগলো । উপভোগ করার মতো ।               তুর্গা বাঁধ অযোধ্যা পাহাড়ের একটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র । তুর্গা বাঁধে আদিবাসী ছেলেমেয়ে ঘিরে ধরলো । তারা একরকমের খেঁজুরের পাতা দিয়ে তৈরী  হাতের পাখা ও অন্যান্য খেলনা কেনার জন্য চাপ দিলো । তারা ভিক্ষুকের ন্যায় পয়সা চাওয়ার পক্ষপাতী নয় । তাই জিনিস তৈরী করে পর্যটকদের কিনতে চাপ দিচ্ছে । ভাল  লাগলো বাচ্চা ছেলেমেয়েদের উপার্জনের অভিনব প্রয়াস ।  তুর্গা বাঁধের আশেপাশের পাহাড়ি দৃশ্য খুবই মনোরম ।
এবার এলাম মার্বেল লেক । অযোধ্যা পাহাড়ের মাথায় একটি হ্রদ । পাথরের খাঁজ কেটে মার্বেল লেক । রুক্ষ পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের মাথায় প্রকৃতির অশেষ দানে এই মার্বেল লেক । সুন্দর পরিবেশ । মার্বেল লেকের পাশ দিয়ে রাস্তাটা গ্রামের দিকে গেছে । সেই রাস্তা দিয়ে অনেক পুরুষ ও মহিলা রুটি রোজগারের ধান্দায় এদিক-ওদিক ছুটছেন ।
মার্বেল লেক থেকে বেরিয়ে আমরা  সোজা ছুটলাম বামনী ফলস । অযোধ্যা পাহাড়ে পর্যটকদের মূল আকর্ষণ বামনী ফলস । অনেকগুলি সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে নামতে হবে । তাই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিলাম সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার জন্য । পাঁচশ মিটারের বেশী নীচে নামতে হবে  । সহ-পর্যটকেরা ফলস দেখার জন্য নীচে নামছেন । পাহাড় ঘেঁষে জলপ্রপাত । জলের শব্দ অনবরত । পাহাড়ের চূড়া থেকে ঝরনার জল । সকলেই ঝরনার জলের নীচের দিকে সিঁড়ি বেয়ে নামছে । বিশাল পাথরের মধ্যে দিয়ে জলপ্রবাহ । জলের শব্দ পর্যটকদের শিহরিত করে । অযোধ্যা পাহাড়ের বামনি জলপ্রপাত সৌন্দর্য্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন । সিঁড়ি দিয়ে নামা ও ওঠা খুব কষ্টকর । ঝরনার নীচের অংশ দেখার তাগিদে নীচে নামলাম ।  পাহাড়ের পাথরের মধ্যে দিয়ে ঝরনার জলপ্রপাত  ভাল লাগার চরম অনুভূতি ।
পরবর্তী চড়িদা গ্রাম । অনেকে আবার চড়িদা ভিলেজ বলেও থাকে । এখানে মুখোশ পাওয়া যায় । মুখোশ অযোধ্যা পাহাড়ের একটি বড় কুটির শিল্প । অনেক শিল্পী এই মুখোশ তৈরীর কাজে নিয়োজিত । পুরুলিয়ার ছৌ-নাচ বিশ্ব জোড়া খ্যাত । সেই ছৌ-নাচের মুখোশ চড়িদা গ্রামে তৈরী হয় । তা ছাড়া চড়িদা গ্রামে প্রতি বছর ছৌ-নাচের অনুষ্ঠান হয় । দোকানগুলিতে বিভিন্ন দেব-দেবতার মুখোশ পাওয়া যায় । ইদানীং শিল্পীরা মুখোশ তৈরী করার পর সেই মুখোশে বিভিন্ন ধরনের ডেকোরেশন করছেন  । মুখোশটাকে সাজানো হয় । যার জন্য চড়িদার মুখোশ এখন বেশী আধুনিক এবং রুচিসম্মত ।
চড়িদা গ্রাম থেকে প্রায় ১২কিমি দূরে খয়রাবেরা ড্যাম । সেখানে পৌঁছালাম । সুন্দর সেচ বাঁধ । এই জায়গাটা বাঘমুণ্ডি বনের মধ্যে অবস্থিত । স্থানটির প্রাকৃতিক  সৌন্দর্য মন ভরিয়ে দেয় । খয়রাবেরা ড্যামের বিশেষত্ব হল জায়গাটির নির্মলতা, জলপ্রপাত, ঘন জঙ্গল । রাতের বেলায় নাকি চিতা বাঘ, ভাল্লুক, হরিণ, ময়ূরের ডাক শোনা যায় । এখানে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে । থাকাটাতে আলাদা অনুভূতি । থাকার জন্য রিসোর্ট রয়েছে ।
মার্চ মাসের প্রথম দিকে গেলে অফুরন্ত পলাশ ফুল  । যেটা এই সময়ে দেখার সৌভাগ্য হল না । জনশ্রুতি আছে, অযোধ্যার পাহাড়ের বন-মুরগীর মাংস ভীষণ সুস্বাদু । কিন্তু সেটাও নাকি মার্চ মাসের দিকে সহজলভ্য । এই কারণে মনের মধ্যে একটা আপশোশ রয়েই গেলো । পুরুলিয়ার  প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এত মধুর, যার জন্য এই গানটি খুব জনপ্রিয়, “পিন্দারে পলাশের বন, পালাবো পালাবো মন” ।  তবে হোটেলের মালিক  পলাশ ফুল ফোটার সময়ে অযোধ্যা পাহাড়ে ভ্রমণের আগাম আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলেন । খুব ভোরে হোটেল থেকে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম পুরুলিয়া শহর ঘুরে জয়চণ্ডীপাহাড়, কাশীপুর রাজবাড়ি, গড় পঞ্চকোট, বরন্তি লেক  দেখার উদ্দেশে এবং তারপর বাড়ি ফেরা ।

 


(  ৩  )
পাহাড় থেকে নামার সাথে সাথে পূর্ব আকাশে সূর্যোদয় ঘটলো । ঠিক সেই মুহূর্তে সিরকাবাদে দাঁড়িয়েছিলেন আমার সেই প্রিয় কবি নীরদ দত্ত । তার সঙ্গে দেখা করে আবার চা-পর্ব । তাঁকে আমার দুটি লেখা উপন্যাস উপহার দিলাম ।  তারপর গাড়ি ছুটলো পুরুলিয়া শহরের দিকে ।
পুরুলিয়া শহরে পৌঁছে পুনরায় চা-পর্ব ।
তারপর চললাম কাশীপুর রাজবাড়ি । যথাসময়ে রাজবাড়ি পৌঁছালাম । শোনা যায় কাশীপুরের বর্তমান রাজ বাড়িটি নির্মাণ করেন জ্যোতিপ্রসাদ  । আরও শোনা যায়, জ্যোতিপ্রসাদ পুরুলিয়ায় অনেক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছিলেন । শিক্ষা বিস্তারের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ইত্যাদি । রাজবাড়ির মেয়ের নামেই ভাদু গান । বাংলার লোকসংস্কৃতির অঙ্গ এই ভাদু গান ।  তবে রাজ বাড়িতে এখন প্রবেশ নিষিদ্ধ । সদর গেট বন্ধ । বাইরে থেকে ভিতরের অংশ দেখে বোঝা যায়, রাজ বাড়িটির সংস্কার প্রয়োজন । লোক মুখে জানতে পারলাম, ভিতরে বর্তমান প্রজন্ম রয়েছেন । তিনি নাকি দুর্গা পুজার সময় জনগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন । রাজবাড়িতে দুর্গা পুজা এখনও চালু রয়েছে । রাজবংশধরেরা সেই সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে রাজবাড়িতে এসে মিলিত হন । যাই হোক আমরা বাইরে থেকে ভগ্নপ্রায় রাজ বাড়ি দেখে মন ভরালাম ।
জয়চন্ডীপাহাড় ।  রঘুনাথপুর শহর থেকে ২কিমি এবং আদ্রা থেকে ৪কিমি দূরত্বে জয়চন্ডী পাহাড় । জয়চন্ডী পাহাড় একটি প্রাকৃতিক ও ধর্মীয় পর্যটন স্থান । পাহাড়ের মাথায় চন্ডী মাতার মন্দির । সম্ভবত চন্ডীমাতার নাম অনুসারে পাহাড়টির নাম হয়েছে জয়চন্ডী পাহাড় । জানতে পারলাম পাহাড়ের উচ্চতা ৫০৯ফুট । জয়চন্ডী পাহাড়ের নীচে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে । রয়েছে পার্ক । তবে শীতের মরশুম জয়চন্ডী পাহাড় ভ্রমণের আদর্শ সময় ।
সেখান থেকে গড় পঞ্চকোট । পাহাড়ের ঢোকার মুখে অনেক দোকান । খাওয়ার দোকান ছাড়াও ব্যাগ, হাতের চুড়ি, ইত্যাদির দোকান । বিভিন্ন ধরনের ফলের দোকান । সেখানে চা খেয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়া গেলো । এবার পঞ্চকোটের ইতিহাস ঝালিয়ে নেওয়া  । “পঞ্চকোট রাজবংশের রাজপুরোহিত ও সভাপণ্ডিত রাখাল চন্দ্র চক্রবর্তী  (১৮৭৭-১৯৪৩) মহাশয় প্রণীত “পঞ্চকোট ইতিহাস” থেকে জানা যায় –মহারাজ বিক্রমাদিত্যের উত্তর পুরুষ উজ্জয়নী নগরীর ধার রাজ্যের মহারাজা জগদ্দেও সিংহের পুত্র দামোদর শেখর সিংদেও (জন্ম – ঝালদায় ৮০ খৃষ্টাব্দে)  যে ‘শেখর’ রাজবংশের সূচনা / প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই রাজবংশের ৩১তম রাজা কীর্তিনাথ শেখর, রাজ্যাভিষেকের  (৯২৬ খৃঃ)  পর কোন এক সময়ে তাঁর রাজধানী পাড়া থেকে পঞ্চকোট পাহাড়ের দক্ষিণ পাদদেশে স্থানান্তরিত করেন । এখানে প্রায় ত্রিশ জন রাজা দীর্ঘ আটশ বছর ধরে বংশ পরস্পরায় রাজত্ব করেন । ১৭৫০ খৃষ্টাব্দে মহারাজ শত্রুঘ্ন শেখরের আকস্মিক মৃত্যুর পর সিংহাসন নিয়ে একাধিক নৃশংস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ফলে রাজধানী প্রথমে মহারাজনগর, পরে ১৭৬২-৬৩ সালে রামবণী মৌজায়, ১৭৯৩ সালের পর কেশরগড় এবং অবশেষে ১৮৩২ সালে কাশীপুরে স্থানান্তরিত করা হয় ।  দীর্ঘ দিন ধরে এখানের রাজধানীটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এবং কালের নিয়মে স্থাপত্যগুলি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় ।“ তথ্যসূত্রঃ গড়  পঞ্চকোটে টাঙানো এক নোটিশ থেকে নেওয়া । নোটিশের হেড-লাইন  “পঞ্চকোটস্য রাজশ্রী” — গড় পঞ্চকোট ।
গড় পঞ্চকোট পাহাড়ে ঢোকার মুখে একটা মন্দির রয়েছে  । এলাকাটা প্রাকৃতিক সম্ভারে সমৃদ্ধ । পঞ্চকোট পাহাড় প্রশান্তিতে ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্যে মনোমুগ্ধকর  । শোনা যায় ভেষজ উদ্ভিদে সমৃদ্ধ এই পাহাড় । আরও শোনা গেলো, এক সময় মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই পঞ্চকোট নিয়ে তিনটি কবিতা লিখেছিলেন ।
আমাদের শেষ গন্তব্য বরন্তি লেক । বরন্তি হচ্ছে পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর মহাকুমার একটি গ্রাম । রামচন্দ্রপুর সেচ প্রকল্পের অন্তর্গত এই লেকের পোশাকি নাম রামচন্দ্রপুর জলাধার হলেও লোকে একে বরন্তি লেক নামে চেনে ও জানে । বরন্তি নদীতে বাঁধ দিয়ে এই জলাশয়টি । বর্ষাকালে এলাকাটি ঘন সবুজে ভরে মোহময়ী রূপ ধারন করে । ফেব্রুয়ারী মাসের শেষদিকে কিংবা মার্চ মাসের প্রথম দিকে পলাশ ফুল ফোটে এবং এলাকাটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরিয়ে দেয় । জলাশয়ের আশপাশের মানুষ কিছুটা ক্ষেতি জমিতে কাজ করলেও বেশীর ভাগ সময় জ্বালানী কাঠ কেটে, খেজুরের রস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে । পর্যটন শিল্পের উপরেও অনেক মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল । যাই হোক লেকের বাঁধের উপর  গাড়ি রেখে হেঁটে জলাশয়টি পরিদর্শন করলাম । বরন্তি লেকের ভ্রমণ চিত্ত বিনোদনের অন্যতম অঙ্গ ।
তারপর গাড়ি নিয়ে সোজা বরাকর দিয়ে বাড়ি ফেরা । পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অবর্ণনীয়, বরং বলা চলে অনুভূতির এক অনবদ্য স্বাদ আস্বাদন ! তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত ও অভিজ্ঞতার নিরিখে ।

।। কলমে : দিলীপ রয়।।

(সমাপ্ত)
———০———-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here