ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবল প্রতাপী ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ছিলেন এক উল্লেখযোগ্য নাম। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই জানুয়ারি লণ্ডনের উপকণ্ঠে নরউডে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম কৃষ্ণধন ঘোষ, মায়ের নাম স্বর্ণলতা ঘোষ। তাঁর পৈতৃক নিবাস অধুনা পশ্চিমবঙ্গের কোন্নগর ৷ ব্রিটিশ ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক মহান বিপ্লবীবারীন্দ্রকুমার ঘোষ যিনি বারীন ঘোষ নামে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন।
ঘোষ বংশের সন্তান বারীন্দ্রকুমার সুলেখক ছিলেন। তার প্রবন্ধ ও নানা লেখা ইংরেজি ও বাংলায় বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। দ্বীপান্তরের বাঁশি, পথের ইঙ্গিত, আমার আত্মকথা, অগ্নিযুগ, ঋষি রাজনারায়ণ ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য রচনা।’অনুশীলন সমিতি’র আদর্শকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, বারীন ঘোষ একটি পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তাব করেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই মার্চ থেকে অরবিন্দের সমর্থনে সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে ‘যুগান্তর’ প্রকাশিত হতে থাকে। যুগান্তর ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করলে, ব্রিটিশ কর্মকর্তারা এই পত্রিকার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। এই সূত্রে বেশ কয়েকবার তিনি রাজনৈতিক হয়রানির স্বীকারও হন। কলকাতার ৩২ নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি তার পরিকল্পনায় বোমা তৈরির কারখানারূপে ব্যবহৃত হতো। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কলকাতাস্থ মানিকতলায় মুরারীপুকুরে বারীন ঘোষদের বাগান বাড়িতে এক সশস্ত্র বিপ্লবী দল গঠিত হয়। এই দলটি পরবর্তী সময়ে ‘যুগান্তর বিপ্লবী দল’ নামে পরিচিতি লাভ করে। সাধারণভাবে এরপর তিনি সংগোপনে অস্ত্র সংগ্রহ ও বিস্ফোরক তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই পরিকল্পনার সূত্রে বিপ্লবীদের অত্যাধুনিক অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনের কর্মীদের কঠোর সাজা ও দমননীতির কারণে, কলকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড বাঙালিদের চরম ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। বিশেষ করে, আলিপুর আদালত প্রাঙ্গনে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণ করার জন্য কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড, সুশীল সেন নামক ১৬ বছরের এক কিশোরকে প্রকাশ্য স্থানে বেত মারার আদেশ দেন। এই কারণে কিংসফোর্ডকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এবং এই সূত্রে ৩০ এপ্রিল ১৯০৮-এ মুজাফফরপুর, বিহারে রাত সাড়ে আটটায় ইওরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বোমা ছুড়ে তিনজনকে হত্যা করেন ক্ষুদিরাম বসু। এই বোমা হামলার পর পুলিশ অনুসন্ধানের সূত্রে ২রা মে ৩২ নম্বর মুরারিপুকুরের বাগান বাড়িতে বোমা তৈরির কারখানা আবিষ্কার করেন এবং বোমা তৈরি মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ এই বোমা হামলার তদন্তের সূত্রে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে মে মামলা দায়ের করে। ঐতিহাসিকভাবে এই মামলা ‘আলীপুর বোমা মামলা’ নামে চিহ্নিত করা হয়। সেই ঘটনার পর আলিপুর বোমা মামলা শুরু হয়। ১৯০৯ সালের ৬ মে আলিপুর বোমা মামলার রায় দেওয়া হয়। রায়ে বিচারক বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ও উল্লাসকর দত্তকে মৃত্যুদণ্ড দেন। উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র কানুনগো, বিভূতিভূষণ সরকার, বীরেন্দ্র সেন, সুধীর ঘোষ, ইন্দ্রনাথ নন্দী, অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য, শৈলেন্দ্রনাথ বসু, হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল, ইন্দুভূষণ রায়ের, দ্বীপান্তর দণ্ড হয়। পরেশ মৌলিক, শিশির ঘোষ, নিরাপদ রায় ১০ বছর দ্বীপান্তর দণ্ড, অশোক নন্দী, বালকৃষ্ণ হরিকোণে, শিশির কুমার সেন ৭ বছর দ্বীপান্তর দণ্ড এবং কৃষ্ণ জীবন সান্যাল ১ বছর কারাদণ্ড প্রাপ্ত হন। পরে আপিলে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তের মৃত্যুদণ্ড রহিত হয় এবং তার বদলে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হয়।বারীন্দ্রকুমারের অগ্রজ অরবিন্দ ঘোষ মুক্তি পান এবং অনেকের সাজা হ্রাস করা হয়। এর প্রায় এক দশক পর ব্রিটিশ-ভারতীয় সরকার রাজনৈতিক বন্দীদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসের দিকে বারীন ঘোষকে কলকাতায় এনে মুক্তি দেওয়া হয়।
পৌঢ় বয়েসে বিবাহ করেছিলেন তিনি। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শৈলজা দেবীকে বিবাহ করেন। এই বছরেই তিনি ‘The Dawn of India’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন। এরপর তিনি কিছুদিন ‘The Stateman’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন।শেষ জীবনে তার রাজনৈতিক ও বিপ্লবী মতাদর্শ বিতর্কিত হয়ে পড়ে। বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লববাদী আন্দোলনের প্রানপুরুষ বারীন্দ্রকুমার ১৯৩৬ সালে পূর্বতন কাজের সমালোচনা করে ‘ভারত কোন পথে’ পুস্তিকা লেখেন।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দৈনিক বসুমতী পত্রিকার সম্পাদক হন। এছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রামানন্দ লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত হন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে তার নাম আজ স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
১৮ এপ্রিল, ১৯৫৯ তিনি প্রয়াত হন।
।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া।।