অনুরূপচন্দ্র সেন : অন্তরালে থেকে যাওয়া ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের শহীদ বিপ্লবী – একটি বিশেষ পর্যালোচনা।।

ভূমিকা:- ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল বহু মানুষের কঠোর পরিশ্রম যার ফলেই ব্রিটিশদের থেকে ভারত রাজনৈতিক দিক থেকে মুক্তি পেয়েছে। হিন্দু মুসলিম সকল শ্রেণীর মানুষ এই মুক্তির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিলেন। আর তাঁদের সেই বলিদনের ইতিহাসে অনেকের কথাই অজানা। ভারত উপমহাদেশের বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী লড়াই-সংগ্রাম সংগঠিত হয় এবং যার ধারাবাহিকতায় ভারত স্বাধীন হয়। এই অন্দোলনে যে সকল বিপ্লবীর নাম সর্বজন স্বীকৃত তাঁদের মধ্যে  অনুরূপচন্দ্র সেন  প্রথমসারির একজন অন্যতম বিপ্লবী ছিলেন। অনুরূপচন্দ্র সেন  ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে এক উল্লেখযোগ্য নাম, যিনি দেশমতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন সম্পূর্ণ রূপে।

ভারতের স্বাধীনতা অন্দলনের অন্যতম বিপ্লবী বীর ছিলেন অনুরূপচন্দ্র সেন। অনুরূপচন্দ্র সেন (১৮৯৮ – ৪ এপ্রিল ১৯২৮) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের শহীদ বিপ্লবী ।   যুগান্তর দলের অন্যতম নেতা অনুরূপচন্দ্র সেন। আজ আমরা ক’জন মনে রেখেছি অনুরূপ সেনকে? স্মৃতির অন্তরালে থেকে গিয়েছেন তিনি।  অনুরূপচন্দ্র সেন এম.এ. ক্লাসের ছাত্র থাকাকালে বিপ্লবী দলের সভ্য হন।

জন্ম ও শিক্ষা—- অনুরূপচন্দ্র সেনের জন্ম অবিভক্ত বাংলার (বর্তমানে বাংলাদেশ) চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ার এক দরিদ্র পরিবারে। পিতার নাম কমলকুমার সেন। চট্টগ্রাম মাদ্রাসা থেকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ৭৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে আই.এ এবং ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বি.এ পাশ করেন ।

মাস্টারদা সূর্য সেন এর সঙ্গে সম্পর্ক—- মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী মাস্টারদা সূর্য সেন ও তিনি দুজনেই চট্টগামের নোয়াপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। একসঙ্গে তাঁরা দেশ মায়ের সেবায় ব্রতী হয়েছেন। তারা ছিলেন পরস্পরের সমবয়েসী বন্ধু। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার বুড়ুল হাইস্কুলে শিক্ষকতাকালীন নানা সামাজিক কাজে নিজেকে ও ছাত্রদের জড়িয়ে রাখতেন। ছাত্র ছাত্রীরা তার উৎসাহে হাতে লেখা জাতীয়তাবাদী ‘সাধনা’ পত্রিকা বের করে। অস্ত্র প্রশিক্ষন, লাঠি খেলা, দেহচর্চা ইত্যাদির গোপন আখড়া গড়ে তুলে স্থানীয় ছাত্র-যুবদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।

বিপ্লবী কর্মকাণ্ড— যে পাঁচজনকে নিয়ে১৯১৮ সনে চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের কেন্দ্র গঠিত হয় তিনি তার অন্যতম ছিলেন। যদিও তিনি অন্তরালেই থেকে গেছেন ভারতের বৈপ্লবিক আন্দোলনের ইতিহাসে। অপর চারজন হচ্ছেন সূর্য সেন, নগেন সেন (জুলু), অম্বিকা চক্রবর্তী ও চারু বিকাশ দত্ত। চট্টগ্রাম বিপ্লবীদের গোপন সংবিধান তারই রচিত।

গুপ্ত সমিতি বা পল্লি হিতৈষণী সমিতি গঠন—বুড়ুল হাইস্কুলে গণিতের শিক্ষক হিসাবে চাকরি করতে এসে স্থানীয় যুবকদের সশস্ত্র আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের নায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের প্রধান সহকারী অনুরূপচন্দ্র। যদিও ১৯০৫ সাল থেকেই বুড়ুল-সহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়ে গিয়েছে। তবে মাস্টারদার নির্দেশেই ১৯২২ সালে স্টিমারে করে নলদাঁড়ি ঘাটে প্রথম পা রাখেন যুগান্তর দলের অন্যতম নেতা অনুরূপচন্দ্র। শিক্ষকতার পাশাপাশি এলাকার সংস্কৃতিচর্চাতেও ভূমিকা ছিল অনুরূপচন্দ্রের। এলাকার যুবকদের সশস্ত্র বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করতে গড়েছিলেন ‘গুপ্ত সমিতি’ বা ‘পল্লি হিতৈষণী সমিতি’-র মতো সংগঠন।

অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাবরণ— অনুরূপচন্দ্র সেন ১৯২২ সালে দলের নির্দেশে সেখানে সমাজসংস্কারমূলক কাজের সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবীদের এক ঘাঁটি তৈরি করেন। মজুত করে রাখা হতো আগ্নেয়াস্ত্র এবং নিষিদ্ধ বই ও পত্রপত্রিকা। অনুরূপবাবুর হাত ধরে সশস্ত্র বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলেন স্থানীয় যুবকরা। সঙ্গে পান প্রিয় ছাত্র প্রভাস রায়, মুরারীশরণ চক্রবর্তী প্রমুখকে।  সন্ধ্যা হলে হুগলি নদীর পাড় লাগোয়া বাতিঘরের মাঠে তাঁদেরকে নিয়ে চলত অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ। চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠনের অনেক আগেই স্থানীয় বিড়লাপুর-মায়াপুরে অস্ত্রভাণ্ডার লুন্ঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন অনুরূপচন্দ্র। কিন্তু এলাকার জমিদার ও ব্রিটিশ পুলিশের কড়া নজরদারিতে তা ভেস্তে যায়। কিন্তু এর মাঝে দক্ষিণেশ্বর বোমার মামলায় তাঁর নাম জড়ায়। দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলায় ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৬ তারিখে গ্রেপ্তার হন বুড়ুল থেকেই।

গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে অরন্ধন — ১৯২৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর বুড়ুল থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিস। এরপর তাঁকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় নলদাঁড়ি ঘাটে। সেখান থেকে কলকাতায়। সেদিন ব্রিটিশ পুলিসের বিরুদ্ধে জড় হয়ে আওয়াজ তুলেছিলেন এলাকার মানুষ। শিক্ষক অনুরূপচন্দ্রকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে একদিন গোটা এলাকায় হয় অরন্ধন।  বিচারে অনুরূপচন্দ্রের সাজা হয়। তাঁকে আলিপুর মেট্রোপলিটন জেলে রাখার এক মাস পর জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়িতে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে প্রবল অত্যাচার ও চরম অব্যবস্থায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন তিনি।

আসুস্থতা ও বেনারস যাত্রা —- দিন কে দিন বেড়েই চলেছিল তাঁর অসুস্থতা। ক্রমেই যেন বিছানা থেকে উঠে বসারই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছিলেন।  স্বাস্থ্য ভেঙে পড়লে তার প্রভাব মনের ওপর পড়তে বাধ্য। সেই ছাত্রাবস্থাতেই মনে আধ্যাত্মিকভাব জাগ্রত হয়েছিল। বিবাগী হয়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন হিমালয়ে। তবে বিপ্লবীদলে যোগ দেওয়ার পর বেশ কয়েক বছর বৈরাগ্যভাব স্তিমিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯২৫-এর পর থেকে মনের মধ্যে শ্রীঅরবিন্দের প্রভাব ব্যাপকভাবে কাজ করেছে। তারপর দীর্ঘদিন রোগে ভুগে জীর্ণ হয়ে অনুরূপের বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাও যেন নষ্ট হয়ে গেছে। মন মনে চেয়েছিলেন ভগবানের শরণ নিতে। এমন সময়  এলো ওপরমহল থেকে অর্ডার। বাংলায় আর থাকতে পারবেন না। আপনাকে এক্সটার্নমেন্টে যেতে হবে। কোথায় যেতে চান আপনি?” প্রশ্নটা শুনে হেসে ফেললেন অনুরূপ। প্রহসন আর কাকে বলে! আবার একই প্রশ্ন, “আপনি কোথায় যেতে চান বলুন?” “বেনারস।” অনুরূপের মুখ দিয়ে যেন আপনা আপনি বেরিয়ে এসেছিলো শব্দটা। তাই কথাটা বলে হেসে ফেললেন উনি, সে হাসি তাচ্ছিল্যের! অবাক কাণ্ড! অনুরূপের আবেদন সরকার মেনে নিল। তাই কদিন বাদেই পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে ভগ্ন-শরীরে কোনোমতে উনি পৌঁছলেন কাশীধামে। উঠলেন ‘পার্বতী আশ্রম’ নামের একটা হোটেলে।

মৃত্যু—- আসুস্থ অনুরূপচন্দ্রকে পরে কাশীতে পাঠানো হয়। সেখানে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় শ্রীরামকৃষ্ণ অনাথ আশ্রমে মারা যান (৪ এপ্রিল ১৯২৮ ) মহান এই স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর।

।।তথ্য ঋণ সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবপেজ।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *