চার্লি চ্যাপলিন : মূক চলচ্চিত্রের অমর প্রতিভা।

0
97

ভূমিকা—

স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র ছিলেন একজন ব্রিটিশ চলচ্চিত্র অভিনেতা, পরিচালক ও সুরকার। হলিউড চলচ্চিত্র শিল্পের শুরুর সময় থেকে মধ্যকাল পর্যন্ত তিনি তার অভিনয় ও পরিচালনা দিয়ে সাফল্যের শিখরে আরোহণ করেন। চ্যাপলিনকে বড় পর্দার শ্রেষ্ঠতম মূকাভিনেতা ও কৌতুকাভিনেতাদের একজন বলেও বিবেচনা করা হয়। চলচ্চিত্র শিল্প জগতে চ্যাপলিনের প্রভাব অনস্বীকার্য। ভিক্টোরীয় যুগে তার শৈশব থেকে ১৯৭৭ সালে তার মৃত্যুর এক বছর পূর্ব পর্যন্ত তার কর্মজীবনের ব্যাপ্তি প্রায় ৭৫ বছর এবং এই সময়ে তার বর্ণাঢ্য ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনে খ্যাতি ও বিতর্ক, দুইই নিম্ন থেকে শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে গেছে।

জন্ম—-

চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন ১৮৮৯ সালের ১৬ই এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা চার্লস চ্যাপলিন সিনিয়র এবং মাতা হ্যানা চ্যাপলিন (জন্মনাম: হ্যান হ্যারিয়েট পেডলিংহাম হিল)। চার্লি চ্যাপলিনের জন্ম সম্পর্কিত বৈধ কোনো প্রমাণপত্র পাওয়া যায়নি, তাই তার জন্ম নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।চার্লি চ্যাপলিনের জীবন যেন আগাগোড়া পুরোটাই রহস্যে ঘেরা।  সংবাদ মাধ্যম তার জন্মস্থান সম্পর্কে নানা সময়ে নানা রকম তথ্য দিয়েছে। কিন্তু চ্যাপলিনের মতে, তিনি দক্ষিণ লন্ডনের ওয়ালওর্থের ইস্ট স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেছেন। তার নাম চার্লি চ্যাপলিন নিয়েও সন্দেহ আছে অনেকের! যুক্তরাজ্যের জাতীয় আর্কাইভ থেকে প্রকাশিত নথি থেকে জানা যায়, চার্লি চ্যাপলিনের আসল নাম হলো ইসরায়েল থর্নস্টেইন। চ্যাপলিন তার ছদ্মনাম! তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দারা চ্যাপলিনের ছদ্মনাম নিয়ে কোনো প্রমাণ খুঁজে পাননি।

শৈশব—-

চ্যাপলিনের শৈশব প্রচণ্ড দারিদ্র্য আর কষ্টে জর্জরিত ছিল। তার শৈশব কাটে তার মা হ্যানা এবং ভাই সিডনির সাথে কেনিংটন জেলায়। চ্যাপলিন সিনিয়র তাদের কোন আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করতেন না এবং হ্যানার মাঝে মাঝে সেবিকা ও পোশাক তৈরির কাজ ছাড়া উপার্জনের কোন পথ ছিল না। অত্যধিক দারিদ্রের কারণে চ্যাপলিনকে তার সাত বছর বয়সে ল্যামবেথ কর্মশালায় কাজের জন্য পাঠানো হয়।সাউথওয়ার্ক কাউন্সিল তাকে দারিদ্রের কারণে সেন্ট্রাল লন্ডন ডিস্ট্রিক্ট স্কুলে পাঠায়। চ্যাপলিন এই পরিস্থিতিকে “অবহেলিত জীবনকাল” বলে উল্লেখ করেন। ১৮ মাস পরে কিছু দিনের জন্য তিনি তার মায়ের সাথে থাকেন এবং ১৮৯৮ সালের জুলাইয়ে হ্যানা তাকে পুনরায় কর্মশালায় প্রেরণ করেন। চার্লি ও সিডনিকে এরপর দরিদ্র শিশুদের জন্য নির্মিত নরউড স্কুল নামক আরেকটি ইনস্টিটিউটে প্রেরণ করা হয়।।

পথচলা শুরু—

চ্যাপলিন তার শৈশব থেকেই শিশুশিল্পী হিসেবে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রঙ্গশালার সাথে সফর করতেন এবং পরে একজন মঞ্চাভিনেতা ও কৌতুকাভিনেতা হিসেবে অভিনয় শুরু করেন। ১৯ বছর বয়সে তিনি স্বনামধন্য ফ্রেড কার্নো কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হন, যারা তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে নিয়ে যায়। চ্যাপলিন সেখানে হলিউড চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে যুক্ত হন এবং ১৯১৪ সালে কিস্টোন স্টুডিওজের হয়ে বড় পর্দায় অভিনয় শুরু করেন। অচিরেই তিনি তার নিজের সৃষ্ট ভবঘুরে দ্য ট্রাম্প চরিত্রের মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করেন এবং তার অনেক ভক্তকূল গড়ে ওঠে। ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পর্তুগালে “শার্লট” নামে পরিচিত চ্যাপলিনের ট্রাম্প চরিত্রটি ভবঘুরে হলেও ব্রিটিশ ভদ্রজনোচিত আদব-কায়দায় সুসংস্কৃত এবং সম্মানবোধে অটুট। শার্লটের পরনে চাপা কোট, সাইজে বড় প্যান্ট, বড় জুতো, মাথায় বাউলার হ্যাট, হাতে ছড়ি আর অদ্বিতীয় টুথব্রাশ গোঁফ। চ্যাপলিন শুরুর দিক থেকেই তার চলচ্চিত্রগুলো পরিচালনা করতেন এবং পরবর্তীতে এসানে, মিউচুয়াল ও ফার্স্ট ন্যাশনাল করপোরেশনের হয়েও চলচ্চিত্র পরিচালনা চালিয়ে যান। ১৯১৮ সালের মধ্যে তিনি বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের মর্যাদা লাভ করেন।

অভিনয় জীবন—

তার নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হল দ্য কিড (১৯২১), পরবর্তীতে তিনি আ ওম্যান অব প্যারিস (১৯২৩), দ্য গোল্ড রাশ (১৯২৫) এবং দ্য সার্কাস (১৯২৮) চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন এবং এসব চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেন। ১৯৩০ এর দশকে তিনি সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ করার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন এবং নির্বাক সিটি লাইট্‌স (১৯৩১) ও মডার্ন টাইমস (১৯৩৬) নির্মাণ করে প্রশংসিত হন। চ্যাপলিন তার পরবর্তী চলচ্চিত্র দ্য গ্রেট ডিক্টেটর (১৯৪০) এ অতিমাত্রায় রাজনৈতিক হয়ে ওঠেন এবং আডলফ হিটলারকে ব্যঙ্গ করেন। ১৯৪০ এর দশকে চ্যাপলিনকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় এবং তার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। তিনি সমাজতান্ত্রিকদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বলে অভিযোগ ওঠে, পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে পিতৃত্বের মামলা চলাকালে তিনি কম বয়সী অপর এক মহিলাকে বিয়ে করায় তাকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে এফবিআইয়ের তদন্ত শুরু হলে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে চলে যান এবং সেখানে বসবাস শুরু করেন। তিনি তার পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলোতে তার ট্রাম্প সত্তা বিসর্জন দেন এবং মঁসিয়ে ভের্দু (১৯৪৭), লাইমলাইট (১৯৫২), আ কিং ইন নিউ ইয়র্ক (১৯৫৭) এবং আ কাউন্টেস ফ্রম হংকং (১৯৬৭) চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের অন্যতম মৌলিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব চ্যাপলিন নিজের ছবিতে নিজেই অভিনয় করতেন, এবং চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা, পরিচালনা, প্রযোজনা এমনকি সঙ্গীত পরিচালনাও করতেন। তিনি তার সকল চলচ্চিত্র ত্রুটিমুক্ত রাখার চেষ্টা করতেন এবং তার আর্থিক স্বাধীনতার কারণে তিনি একটি চলচ্চিত্রের গল্পের বিকাশ ও চলচ্চিত্র নির্মাণে অধিক সময় ব্যয় করতে পারতেন। তার চলচ্চিত্রগুলোতে বৈরিতার সাথে দ্য ট্রাম্পের সংগ্রামের করুণ রসের সাথে স্ল্যাপস্টিক হাস্যরস বিদ্যমান ছিল। কয়েকটি চলচ্চিত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়বস্তু ছিল এবং কয়েকটিতে আত্মজীবনীমূলক উপাদান ছিল।  মৃত্যুর পরও চ্যাপলিন তার নির্মিত দ্য গোল্ড রাশ, সিটি লাইট্‌স, মডার্ন টাইমস ও দ্য গ্রেট ডিক্টেটর চলচ্চিত্র দিয়ে অমর হয়ে আছেন। এই চলচ্চিত্রগুলোকে প্রায়ই মার্কিন চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা তালিকায় স্থান করে নিতে দেখা যায়।

ব্যক্তিগত জীবন—-

সুন্দরীদের প্রতি বিশেষ দূর্বলতা ছিল চ্যাপলিনের! নিজের প্রথম ভালোবাসায় ব্যর্থ হয়ে পরে একে একে চারটি বিয়ে করেন! প্রথম তিন স্ত্রী মিলড্রেড হ্যারিস (১৯১৮ – ২০), লিটা গ্রে (১৯২৪ – ২৭) ও পোলেট গোদা (১৯৩৬ – ৪২)- র সাথে সম্পর্কের শেষটা ছিল তিক্তকর। খারাপ হতে হতে বিবাহ বিচ্ছেদে গিয়ে গড়ায় প্রতিটি সম্পর্ক। তবে  শেষ স্ত্রী উনা ও নীল কে সম্ভবত সত্যিকারে ভালোবসেছিলেন তিনি। ১৯৪৩ সালে উনা-র এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন চ্যাপলিন। জীবনের বাকিটা সময় এক সাথেই কাটিয়েছেন দুজন।

পুরস্কার ও সম্মাননা —–

চ্যাপলিন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন এবং এর বেশিরভাগই তার জীবনের শেষের দিকে। ১৯৭৫ সালের নববর্ষ সম্মাননায় তিনি কমান্ডার অব দি অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ারের নাইট উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি ১৯৬২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লেটার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি এবং ইংমার বারিমান যৌথভাবে ইর‍্যাজমাস পদক লাভ করেন, এবং ১৯৭১ সালে ফ্রান্স সরকার তাকে লেজিওঁ দনরের কমান্ডার উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৯৭২ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব থেকে চ্যাপলিন বিশেষ গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার লাভ করেন, এবং লিংকন সেন্টার ফিল্ম সোসাইটি থেকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন। লিংকন সোসাইটি প্রদত্ত পুরস্কারটি পরবর্তীতে চ্যাপলিন পুরস্কার হিসেবে প্রতি বছর চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রদান করা হচ্ছে। ১৯৭২ সালে হলিউড ওয়াক অব ফেমে চ্যাপলিনের নামাঙ্কিত তারকা খচিত হয়, ১৯৫৮ সালে তার নামে এই তারকা খচিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তার রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে তখন তা বাদ দেওয়া হয়েছিল।
চ্যাপলিন তিনবার একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন। প্রথমটি ১৯২৯ সালে “দ্য সার্কাস চলচ্চিত্রে অভিনয়, এর লেখনী, পরিচালনা এবং প্রযোজনায় ভিন্নতা এবং প্রভিতার” স্বাক্ষর স্বরূপ একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার, ১৯৭২ সালে “চলচ্চিত্র নির্মাণকে এই শতাব্দীর শৈল্পিক রূপে তাঁর অপরিমেয় অবদান ও প্রভাবের জন্য” তিনি তার দ্বিতীয় সম্মানসূচক পুরস্কার, এবং ১৯৭৩ সালে লাইমলাইট চলচ্চিত্রের জন্য রে রাশ ও ল্যারি রাসেলের সাথে যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ সুরের পুরস্কার এছাড়া তিনি দ্য গ্রেট ডিক্টেটর চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, শ্রেষ্ঠ মৌলিক চিত্রনাট্য এবং শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র প্রযোজকের পুরস্কার এবং মঁসিয়ে ভের্দু চলচ্চিত্রের জন্য অপর একটি শ্রেষ্ঠ মৌলিক চিত্রনাট্য পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে ব্রিটিশ একাডেমি অব ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন আর্টস (বাফটা) থেকে ফেলোশিপ প্রদান করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস চ্যাপলিনের ছয়টি চলচ্চিত্রকে জাতীয় চলচ্চিত্র রেজিস্ট্রিতে সংরক্ষণের জন্য নির্বাচিত করেছে। চলচ্চিত্রগুলো হল দি ইমিগ্র্যান্ট (১৯১৭), দ্য কিড (১৯২১), দ্য গোল্ড রাশ (১৯২৫), সিটি লাইট্‌স (১৯৩১), মডার্ন টাইমস (১৯৩৬), এবং দ্য গ্রেট ডিক্টেটর (১৯৪০)।

চার্লি সম্পর্কে কিছু তথ্য—

(ক) চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন প্রথম এক্টর যে কিনা টাইমস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছিলেন।
(খ) তিনি ৪ বার বিয়ে করেছিলেন।
(গ) তিনি একটি মাত্র অস্কার পেয়েছিলেন। তিনি “লাইমলাইট” মুভির জন্য বেস্ট মিউজিক এর জন্য অস্কার পেয়েছিলেন।
(ঘ) তার মেয়ে  Geraldine Chaplin ১৯৯২ সালের “Chaplin” মুভিতে তার মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
(ঙ) তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন এমন সন্দেহে হলিউড “ওয়াক অফ ফেইম” থেকে তার নাম উঠিয়ে দেয়া হয় এবং সেটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

মৃত্যু—-

তিনি প্রয়াত হন ২৫ শে ডিসেম্বর, ১৯৭৭, ভিভে, সুইজারল্যান্ড।

।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট ।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here