আজ ১৯শে মে । ১৯৬১ সালের আজকের দিনে বাংলা মাতৃভাষা অন্দোলনে অসম রাজ্যের শিলচরে ১১ জন তরতাজা প্রাণ দিয়েছিলেন ।
প্রথমেই বলে রাখি অসম রাজ্যে দুটি উপত্যকা — একটি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা যেমন গুয়াহাটি ও আশপাশ এলাকা এবং অন্যটি হচ্ছে বরাক উপত্যকা । ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় অসম রাজ্যের অন্তর্গত বাংলাভাষী ভূ-খণ্ড বরাক উপত্যকার মধ্যে রয়েছে করিমগঞ্জ, হইলাকান্দি, বদরপুর, শিলচর প্রভৃতি বাঙালি অধ্যুষিত শহর । দেশ বিভাগের আগে অবিভক্ত সিলেট জেলাসহ এই বরাকের অধিবাসী বাঙালিরাই পুরো আসাম প্রদেশের নেতৃত্ব দিয়েছে । আপনাদের হয় তো মনে থাকবে, অবিভক্ত অসম রাজ্য ভেঙে তৈরি হয় ত্রিপুরা, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদেশ রাজ্য ।
আসামের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষার আন্দোলন ছিল আসাম সরকারের অসমীয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে । ১৯৬০-৬১ সালের ঘটনা । তৎকালীন আসাম প্রদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিলো, বাংলাভাষী অধ্যুষিত এই অঞ্চলের সরকারি ভাষা হবে অসমীয়া । বরাক উপত্যকার সাধারণ মানুষ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এই সিদ্ধান্তকে ভাল চোখে দেখলেন না । তাই বাংলা ভাষার স্বীকৃতির জন্যে তাঁরা মরণপণ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন । এই গণ আন্দোলনের প্রধান উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে ১৯৬১ সালের ১৯ মে । সেদিন ১১ জন প্রতিবাদীকে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে আসাম পুলিশ গুলি করে হত্যা করে । সেই আন্দোলনের জেরে শেষপর্যন্ত আসাম সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল । শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তারপর থেকে ১৯শে মে, বাংলা ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হচ্ছে সারা দেশে ।
এবার পেছনের দিকে আসা যাক । আমরা জানি, পাকিস্তান সরকারের উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী ভাষা অন্দোলনের কথা । ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বরকত-সালাম-জব্বারেরা শহিদ হয়েছিলেন বাংলা ভাষার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে । তারপর ধাপে ধাপে বাংলা ভাষার নিরিখে ১৯৭১ সালে জন্ম নিয়েছিল একটি রাষ্ট্র, নাম বাংলাদেশ ।
এবারে আসছি তৎকালীন আসাম রাজ্যের বাঙালী অধ্যুষিত বরাক উপত্যকায় অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য চক্রান্ত প্রসঙ্গে । ১৯৬০ সালের এপ্রিলে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে অসমীয়া ভাষাকে প্রদেশের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার একটি প্রস্তাবের সূচনা হয় । তারপর ১০ অক্টোবর, ১৯৬০ সালের তদানীন্তন আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়াকে আসামের একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন । যদিও উত্তর করিমগঞ্জ-এর বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন । কিন্তু তা সত্ত্বেও ২৪ অক্টোবর প্রস্তাবটি বিধানসভায় গৃহীত হয় ।
তারপর অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরূদ্ধে বরাক উপত্যকার মানুষদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা শুরু হয় । মানুষ প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন । ফলশ্রুতি হিসাবে বরাক উপত্যকার মানুষেরা সরকারের প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন । আসাম সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির মানুষেরা সংকল্প দিবস হিসাবে পালন করেন । বরাকের জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য গণ সংগ্রাম পরিষদ ২৪ এপ্রিল দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করেছিল । ২মে শেষ হওয়া এই পদযাত্রাটিতে অংশ নেওয়া অন্দোলনকারিরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকাটির গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন । পদযাত্রার শেষে সিদ্ধান্ত হয়, ১৯ মে তাঁরা ব্যাপক হরতাল করবেন । ১৯ মে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং শুরু হয় । করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারী কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট, ইত্যাদিতে পিকেটিং করেন । শিলচরে তারা রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন । বিকেল ৪টার সময়সূচির ট্রেনটির সময় পার হওয়ার পর হরতাল শেষ করার কথা ছিল । ভোর ৫:৪০ এর ট্রেনটির একটিও টিকিট বিক্রি হয়নি । সকালে হরতাল শান্তিপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত হয়েছিল । কিন্তু বিকালে স্টেশনে অসম রাইফেল এসে উপস্থিত হয় । বিকেল প্রায় ২:৩৫ নাগাদ স্টেশনে আন্দোলনকারীদেরকে বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে । এরপর সাত মিনিটের ভিতর তারা ১৭ রাউণ্ড গুলি আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে চালায় । ন’জন সেদিনই নিহত হয়েছিলেন, দু’জন পরে মারা যান । (নীচে শহীদদের ফটোসহ নাম দেওয়া হলো ) । সবচেয়ে যেটি গুরুত্বপূর্ণ, প্রথম একজন মহিলা ভাষা অন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন, নাম কমলা ভট্টাচার্য ।
সেই আন্দোলনের জেরে শেষ পর্যন্ত আসাম সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল এবং আসাম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল । তারপর সেই ঘটনার পর থেকে ১৯শে মে বাংলা ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে সারা দেশে । উল্লেখ থাকে যে বরাক উপত্যকায় শুধু নয়, পৃথিবীর আপামর বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ ১৯ মে কে বাংলা ভাষা শহীদ দিবস হিসাবে পালন করে আসছে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে । তাই বলা চলে, ১৯৬১ সালের ১৯শে মে বরাক উপত্যকার শিলচরের ভাষা অন্দোলন — বিশ্বের মাতৃভাষা আন্দোলনের অন্যতম দৃষ্টান্ত । (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত)
১৯শে মে ভাষা দিবসের শহীদদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
Leave a Reply