গোটা বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে বুদ্ধ পূর্ণিমা। প্রতি বছর বৈশাখ পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। এই পবিত্র দিনটি সনাতন ও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের জন্য বিশেষ। এদিন সারাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশ। রীতি মেনে, বৌদ্ধ মঠ ও মন্দির পরিষ্কার করা হয়। মন্দির ও মঠগুলি খুব সুন্দর করে সাজানো হয়। এ উপলক্ষে বিশেষ পুজো ও সৎসঙ্গের আয়োজন করা হয়। সব মিলিয়ে দেশ ও বিশ্বে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয় বৌদ্ধ পূর্ণিমা।
গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন (বুদ্ধ জয়ন্তী, বুদ্ধ পূর্ণিমা বা বুদ্ধ পূর্ণামী নামেও পরিচিত) হলো পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে পালিত বৌদ্ধধর্মীয় উৎসব। বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম বা গৌতম বুদ্ধের জন্মের স্মরণে পালিত হয়। এটি তার বুদ্ধ-জ্ঞান অর্জনের দিন হিসেবেও পরিচিত।
বুদ্ধ পূর্ণিমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বৈশাখ মাসের এই পূর্ণিমা দিবসে মহামানব বুদ্ধের জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল বলে দিনটি ‘বুদ্ধ পূর্ণিমা’ নামে খ্যাত। খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দের এ দিনে গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন, ৫৮৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এ দিনে তিনি সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে জগতে বুদ্ধ নামে খ্যাত হন এবং ৫৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এ দিনে তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। সিদ্ধার্থের বুদ্ধত্বলাভের মধ্য দিয়েই জগতে বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তিত হয়।
গৌতম নামকরণের কারণ —
গৌতম বুদ্ধর পিতার নাম শুদ্ধোধন ও মাতার নাম মায়া দেবী। তার পিতা ছিলেন শাক্য গণের রাজা। মাত্র ৭ দিন বয়সে ভগবান বুদ্ধের মা মারা যান। সেই সময় তিনি তাঁর মায়ের প্রকৃত বোন প্রজাপতি গৌতমীর কাছে লালিত-পালিত হন। ২৯ বছর বয়সে, ভগবান বুদ্ধ একজন সন্ন্যাসী হন এবং ঈশ্বর ও সত্যের সন্ধানে যাত্রা করেন।
বৌদ্ধ পুঁথিগুলি অনুসারে, পিতা শুদ্ধোধন তার জীবনে বিলাসিতার সমস্ত রকম ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও সিদ্ধার্থ বস্তুগত ঐশ্বর্য্য যে জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না, তা উপলব্ধি করা শুরু করেন।বকথিত আছে, উনত্রিশ বছর বয়সে রাজকুমার সিদ্ধার্থ প্রাসাদ থেকে কয়েকবার ভ্রমণে বেরোলে তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ, একজন অসুস্থ মানুষ, একজন মৃত মানুষ ও একজন সন্ন্যাসীকে দেখতে পান। এই দৃশ্যগুলি দেখে সিদ্ধার্থ তাঁর রাজজীবন ত্যাগ করে একজন সন্ন্যাসীর জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধার্থ এক রাত্রে তাঁর পরিবারকে নিঃশব্দ বিদায় জানিয়ে রাজ প্রাসাদ ত্যাগ করেন। এরপর তিনি আধ্যাত্মিকতার পথে হাঁটেন এবং শীঘ্রই তিনি বিহারের বুদ্ধগয়াতে বোধি গাছের নীচে সত্য জ্ঞান অর্জন করেন।
বৈশাখী পূর্ণিমা দিনটি বুদ্ধের ত্রিস্মৃতি বিজড়িত। এই পবিত্র তিথিতে বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বোধি বা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন এবং মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন। এই দিনে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীগণ স্নান করেন, শুচিবস্ত্র পরিধান করে মন্দিরে বুদ্ধের বন্দনায় রত থাকেন। ভক্তগণ প্রতিটি মন্দিরে বহু প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করেন, ফুলের মালা দিয়ে মন্দিরগৃহ সুশোভিত করে বুদ্ধের আরাধনায় নিমগ্ন হন। এছাড়া বুদ্ধগণ এই দিনে বুদ্ধ পূজার পাশাপাশি পঞ্চশীল, অষ্টশীল, সূত্রপাঠ, সূত্রশ্রবণ, সমবেত প্রার্থনা করে থাকেন।
ইতিহাস—-
বৈশাখী পূর্ণিমা বিশেষ পূর্ণ তিথি। এই পূর্ণ তিথিতে সনাতন ধর্মের নবম অবতার এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক ভগবান গৌতম বুদ্ধ নেপালের লুম্বিনীনগরে রাজা শুদ্ধধন এবং মায়াদেবীর পুত্র রূপে ধরা ধামে অবতীর্ণ হন। কপিলাবস্তুনগরে বড় হয়ে ওঠেন। রাজপুত্র হিসাবে সমস্ত বিলাসিতা, স্ত্রী যশোদা পুত্র রাহুলও তাঁকে সংসারের মায়ায় আবদ্ধ করতে পারেনি। সন্ন্যাসী এবং শব দেখে তাঁর জীবন সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন হয়। জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যুকে জয় করার উদ্দেশ্যে, স্ত্রী, পুত্র, বিলাসিতা, রাজধর্ম, রাজ ঐশ্বর্য ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের পথপ্রদর্শক হিসাবে হিন্দু ধর্মের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। বুদ্ধ পূর্ণিমার শুভ দিনটি তিনটি স্মৃতি বিজড়িত। এই শুভ তিথিতেই ভগবান বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন, সিদ্ধিলাভ করেন এবং মহাপরি নির্বাণ লাভ করেন।
আর কোন কোন দেশে উদ্যাপন হয়—
বাংলাদেশ—
দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশে এই দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতি বছরই পালিত হয়। বৌদ্ধধর্মের উৎসব হলেও ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশে সর্বসাধারণের জন্য এই দিনটি সরকারি ছুটি থাকে। প্যাগোডায় প্যাগোডায় চলতে থাকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দিবস উদ্যাপনের যাবতীয় কার্যক্রম। এছাড়া বিভিন্ন গ্রাম ও বিহারে এই দিনে মেলা বসে। সবচেয়ে বড় মেলাটি বসে চট্টগ্রামের বৈদ্যপাড়া গ্রামে, যা বোধিদ্রুম মেলা নামে সমধিক পরিচিত।
শ্রীলঙ্কা—
শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি বৌদ্ধ ধর্মে প্রভাবিত দেশসমূহে বিশেষ মর্যাদা সহকারে এই উৎসব পালিত হয়ে থাকে। এইসকল দেশে এই দিনে সরকার কর্তৃক মদ্য, মাছ, মাংসাদির বিক্রয়ের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত থাকে। দেশবাসীগণকে সাদা রঙের পোশাক পরিধানের পরামর্শ দেওয়া হয়। ১৯৫০ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড ফেলোশিপ অফ বুদ্ধিস্ট’ এর প্রথম কনফারেন্সে বৈশাখ মাসের এই পূর্ণিমা তিথিটিতে বুদ্ধের জন্মদিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এছাড়া বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা এই দিনে বুদ্ধ পূজার পাশাপাশি পঞ্চশীল, অষ্টশীল, সূত্রপাঠ, সূত্রশ্রবণ, সমবেদ বন্দনা ও করে থাকেন।
ভগবান বুদ্ধই বৌদ্ধ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁকে ভগবান বিষ্ণুর অবতার বলেও মনে করা হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পবিত্রতম উৎসব হল বুদ্ধ পূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমা । এই পুণ্যোৎসব বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে উদযাপিত হয়।
(১) বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে বৌদ্ধরা বুদ্ধপূজাসহ পঞ্চশীল, অষ্টশীল, সূত্রপাঠ, সূত্রশ্রবণ, সমবেত প্রার্থনা এবং নানাবিধ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তারা বুদ্ধানুস্মৃতি ও সংঘানুস্মৃতি ভাবনা করে।
(২) বিবিধ পূজা ও আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিবিধ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়।
(৩) বৌদ্ধ বিহারগুলিতে বুদ্ধের মহাজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনাসহ ধর্মীয় সভার আয়োজন করা হয়। শিশু-কিশোরদের মধ্যেও নানা উৎসবমুখর আনুষ্ঠানিকতার ধুম পড়ে যায়।
(৪) এই পূর্ণিমাকে ঘিরে অনেক বৌদ্ধবিহারে চলে তিনদিনব্যাপী নানামুখী অনুষ্ঠান।
(৫) ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন ভোরবেলা স্নান করলে সমস্ত পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
(৬) এই দিনটিতে অনেকেই দান-ধ্যান করেন, যারা দরিদ্র তাদের খাওয়ান।
(৭) প্রতিবছর এই দিনে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা প্রচুর ভক্তের সমাগম হয় বুদ্ধগয়া-য়।
(৮) বৌদ্ধধর্মীয় পর্ব হিসেবে এ দিনে সাধারণ সরকারি ছুটি থাকে।
।।তথ্য ঋণ : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবপেজ।।