আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ । তিনি বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার (বর্তমানে পশ্চিম বর্ধ্মান জেলা) আসানসোলের কাছে চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর ডাক নাম “দুখু মিয়া” । তাঁর জীবনকে আমরা চারটি ভাগে ভাগ করতে পারিঃ- প্রাথমিক জীবন ১৮৯৯ — ১৯১৭, সৈনিক জীবন ১৯১৭ – ১৯২০, সাহিত্য জীবন ১৯২০ – ১৯৪২ ও অসুস্থতা জীবন ১৯৪২ – ১৯৭৬ ।
নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয় । স্থানীয় এক মসজিদে সম্মানিত মুয়াজ্জিন (নমাজের সময় হলে অংশ নেওয়ার জন্য আজান দেন) হিসেবেও কাজ করেছিলেন । কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন । ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন । সেই সময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন । তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন । জেলে বন্দী অবস্থায় লেখেন “রাজবন্দীর জবানবন্দী” । নজরুল প্রায় ৩০০০গান রচনা করেন । অধিকাংশ গানে সুরারোপ করেছেন তিনি নিজে, সেগুলি নজরুল গীতি নামে পরিচিত ।
কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন বাঙালি কবি এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের জাতীয় কবি । তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকা রেখে গেছেন । তিনি বাংলা সাহিত্যে, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব । ভারত ও বাংলাদেশ — দুই দেশে তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত । তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি বলা হতো । তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের উপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের ও দাসত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ । বিশেষভাবে উল্লেখ থাকে যে, বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব ছিল অপরিসীম । কাজী নজরুল ইসলাম প্রেম, সাম্য, আর বিদ্রোহের বাণী উচ্চারণ করেছেন আজীবন । যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনি জীবনে ও কাজে বিদ্রোহী কবি । তিনি প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং শেকল ভাঙ্গার গানের মতো কবিতা । “অগ্নিবীণা” হাতে তাঁর প্রবেশ, “ধূমকেতুর” মতো তাঁর প্রকাশ । বাংলা কবিতায় নজরুলের আবির্ভাব একেবারেই উল্কার মতো । কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণা জুটিয়েছে । বাংলা কাব্যে একটি নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন । সেটা হচ্ছে গজল । শ্যামাসঙ্গীত ও ভক্তিগীতিও রচনা করেন । সংগীত বিশিষ্টজনদের মতে রবীন্দ্রনাথ – পরবর্তি নজরুলের গান অনেকটাই ভিন্ন ধরনের নির্মাণ । অধিকাংশ গান সুর প্রধান । বৈচিত্রপূর্ণ সুরের লহরী কাব্যকথাকে তরঙ্গায়িত করে এগিয়ে নিয়ে যায় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজী নজরুল ইসলামকে বর্ণনা করেছিলেন — “ছন্দ ও সরস্বতির বরপুত্র” হিসাবে ।
যদিও উল্লেখিত তবুও বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা । তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন । তার কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল । তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক । রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা নজরুল চেয়েছিলেন । কিন্তু তিনি মনে করতেন এর পথে প্রধান বাধা সাম্প্রদায়িক সংঘাত । সেইজন্য তিনি “দুর্গম গিরি কান্তার মরু” গানে বলেছিলেন —
“হিন্দু না ওরা মুসলমান ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন ?
কাণ্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার ।“
তাঁর লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে । তাঁর কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস ।
দাসত্বের শৃঙ্খলে বদ্ধ জাতিকে শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে মুক্ত হবার ডাক দিয়েছিলেন । তাই তাঁর বিখ্যাত কবিতা “বল বীর / বল উন্নত মম শীর” । অনেকেই বলেন “বিদ্রোহী” কবিতা তাঁকে অমর করে রেখেছে ।
১৯৭২ সালের ২৫শে মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন । রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেন । কবির বাকী জীবন বাংলাদেশেই কাটে ।
পরবর্তীতে কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে “জাতীয় কবি”র মর্যাদা দেওয়া হয় । তাঁর রচিত “চল চল চল ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল” বাংলাদেশের রণসংঙ্গীত হিসাবে গৃহীত ।
১৯৭৬ সালের ২৯শে আগষ্ট ঢাকার পিজি হাসপাতালে কবির জীবনাবসান ঘটে । কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় । এখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ।
পরিশেষে এটাই বলার, ৭৭ বছর তিনি বেঁচেছিলেন এবং এই ৭৭ বছর ছিল তাঁর সৃষ্টি ও সৃজনশীলতার এক বিশাল ইতিহাস । কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪তম জন্মদিনে তাঁকে জানাই শতকোটি প্রণাম । (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত)
———–০———