কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনেও দুই নারী ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন। ঠিক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে যেমন দুইজন নারী অত্যন্ত গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন ।
তেমনই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে ও কাজী নজরুল ইসলামের জীবনে দুই নারীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। শুধুমাত্র তফাৎ ছিলো, এই দুই নারীর মধ্যে মৃণালিনী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী আর কাদম্বরী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বৌদি। রবীন্দ্রনাথের বৌদি কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে দু’বছরের বড় ছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথের কিশোরবেলার খেলার সাথীও ছিলেন। একসাথে বড় হতে হতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যের সকল শাখায় যেমন প্রতিভা প্রস্ফুটিত হতে থাকে, তেমনি কাদম্বরী দেবীও প্রচুর পড়াশুনা করে কবির রচনার প্রথম পাঠক ও প্রধান সমজদার পাঠক হতে পেরেছিলেন। অনেকক্ষেত্রেই কাদম্বরী দেবী কবির সৃষ্ট রচনাগুলোর পর্যালোচনা করে কিছু পরিমার্জন করে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতেও সাহায্য করেছেন। অন্যদিকে মৃণালিনী দেবীও অনেক পড়াশুনা করেছিলেন। কিন্তু অত অল্প সময়ের মধ্যে পাঁচ পাঁচটা সন্তান, তাদের লালন পালন ও সন্তানের অকাল মৃত্যু, বিরাট সংসারের রক্ষণাবেক্ষণ, অতগুলো লোকের রান্না বান্না – এসব নিয়ে তাঁকে সদাই ব্যস্ত থাকতে হতো বলে এদিকটা আর এতো এগুতে পারেন নাই।
অপরদিকে কাজী নজরুল ইসলামের জীবনে দুই নারীই তাঁর নিজের স্ত্রী ছিলেন বলে কেউ বলেন আবার কেউ বলেন নয় , তবে একজনের নাম ছিল সৈয়দা খাতুন আর কবি নজরুল নাম রেখেছিলেন নার্গিস। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কবির কখনো ঘর করা হয়ে ওঠেনি।
আরেক নারী আ আশালতা সেনগুপ্তা এবং ডাকনাম ছিল দুলী, কবি নাম রেখেছিলেন প্রমীলা। এই নারীর সাথে বিয়েটা হয় নার্গিসের সাথে বিয়ের দিন আসর থেকে চলে আসার প্রায় তিন বছর পরে। তবে লক্ষ্যনীয় ব্যপার হলো উভয় নারীই তখনকার বৃহত্তর ত্রিপুরা অর্থাৎ বর্তমানের কুমিল্লার ছিলেন। দুইজনেই বিয়ের পরে অনেক পড়াশুনা করেছিলেন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৌদি কাদম্বরী দেবী যেমন হঠাৎ আত্মহত্যা করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন থেকে বিদায় নেন, তেমনি নার্গিসও কেবলমাত্র বিয়ের রাতটুকু ছাড়া, কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গেও আর কোন সম্পর্কই ছিল না। আবার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী যেমন অসুস্থ হয়ে রবিঠাকুরের অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন, তেমনি কবি নজরুলের স্ত্রী প্রমীলা দেবীও কবি নজরুলের আগেই অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছিলেন।
যেহেতু এখানে কাজী নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গে লিখতে হচ্ছে , তাই কাজী কবি নজরুল ইসলামের বিষয়টির উপর অনুধাবন করতে হলে মনে হয় যতটা গোড়ার শুরু করতে পারা যায়, ততটাই কবির সম্পর্কে জানতে পারবো।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ, ইংরেজি ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দের ২৫শে মে, মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। মাত্র আট বছর বয়সেই কবি পিতা ফকির আহমদকে হারান। টাকা পয়সার অভাবে কবি লেখাপড়া পর্যন্ত করতে পারছিলেন না। এদিকে কবির ছিল প্রচণ্ড গান বাজনায় ঝোঁক । তাই কবি নজরুল নামমাত্র লেখাপড়া করে স্থানীয় *লেটো* গানের দলে যোগ দেন। এখানে কিছুদিন গান করার পর কবির মনে হল যে, এরকম গান তো তিনি নিজেই লিখতে বানাতে পারেন। তাই তিনি গান লেখা শুরু করে দিলেন। ঐ অত অল্পবয়সের লেখা গানের কথা ও ভঙ্গি তখন অনেকেরই নজর কেড়ে নিয়েছিল এবং বেশ কৌতূহলও সৃষ্টি হয়েছিল তাদের মধ্যে। কিন্তু এতে মুশকিল ছিল , সেখান থেকে তার তেমন কিছুই আয় হচ্ছিল না। ফলে ঐ বয়সেই কবি নজরুল গ্রামের হাজী পাহালওয়ান শাহের মসজিদে খাদেমগিরি শুরু করে দেন। ঐ কাজের মধ্যে পীর সাহেবের মাজারে সাঁঝের বাতি দেওয়ার কাজটাও কবিকে করতে হতো। কিন্তু সেই কাজেও কবি নজরুলের তেমন সুবিধে হচ্ছিল না দেখে তিনি মিলিটারিতে গিয়ে যোগ দেন ১৯১৭ সালে।
কবি নজরুল ইসলাম মিলিটারির যে কাজে যোগদান করেন, সেই ইউনিটটার নাম ছিল, – * ৪৯ নম্বর বাঙ্গালী পল্টন*।
মিলিটারিতে যোগদান করার পর কাজের জন্যই কবিকে করাচি চলে যেতে হয়। স্কুলের তেমন পড়াশুনার সুযোগ না হলেও, পড়াশুনা ও জ্ঞান আহরণের অদম্য ইচ্ছা ছিল কবি নজরুলের মধ্যে। তাই কবি কাজের ফাঁকে খোঁজা খুঁজি করে সেখানে একজন জ্ঞানী পাঞ্জাবী মৌলভী সাহেবের সন্ধান পান। সেই মৌলভীর কাছ থেকেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম *দেওয়ান-ই-হাফিজ* ও ফার্সি ভাষার আরো নানা মূল্যবান কাব্যগন্থের সংস্পর্শে আসেন এবং সেই বিষয়গুলোর উপর শিক্ষালাভ করার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেন। এভাবেই একদিন কাজী নজরুল ইসলাম পৃথিবীর অন্যতম প্রথম সারীর মহৎ সাহিত্যের সংস্পর্শে চলে আসেন। কবির গভীর অনুসন্ধিৎসু মন, এবং গভীর কাব্য দর্শনের অতল গভীরে ডুব দেবার সুযোগ পান। কাজী নজরুল ইসলাম মানব মহাজীবনের সন্ধানে ঢোকার সিঁড়ি ধাপে ধাপে পেয়ে যান।
আরব সাগরের পাড়ে বর্তমানের পাকিস্তানের করাচী শহরে বসে তিনি “মুক্তি”, “কবিতা-সমাধি”, “রিক্তের বেদন”, “ব্যথার দান”, “হেনা” নামের ব্যতিক্রমধর্মী, অসাধারণ বিস্ময়কর কবিতা ও গল্প রচনা করতে থাকেন। পাঠক সমাজ তখন বুঝতে পারছিলেন বাংলা সাহিত্যের আকাশে আর একটি প্রবল শক্তিময় আলোর দ্যুতি ছড়ানো সূর্যের আবির্ভাব হতে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে গুজব ওঠে যে, *বাঙ্গালী পল্টন* ভেঙ্গে দেওয়ার কথা । তা শুনেই কবি ভবিষ্যতে কি করবেন সেই চিন্তা করতে করতে দেশের বাড়ি চুরুলিয়ায় এসেছিলেন।
১৯২৯ সালে যখন সত্যিই *বাঙ্গালী পল্টন* ভেঙ্গে দেওয়া হল,তখন কবি বর্ধমান জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এর অধীনে সাব-রেজিস্ট্রার -এর পদের জন্য দরখাস্ত করেন। সেখানেও কিছু সুবিধা না হওয়ায় তিনি চাকরীর খোঁজে কলকাতাতে চলে যান। কলকাতায় পৌঁছেই তিনি প্রথমে সতীর্থ বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মেসে উঠেন। এরপরে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজের সামনে ৩২ নং কলেজ স্ট্রীটে অবস্থিত *বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি* এর কার্যালয়ে যান। সেখানে *বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা* -এর সম্পাদক, কমরেড মোজাফফর আহমেদ ও *মোসলেম ভারত* পত্রিকার কর্ণধার আফজালুল হক থাকতেন। এঁদের সঙ্গে কবির আলাপ হবার পর ঐ ঠিকানাতেই কাজী নজরুল ইসলামের থাকার ব্যবস্থা হয়। এর প্রায় পাঁচ ছয় মাস পরে, কবি নজরুল কাউকে কিছু না বলে হঠাৎই একদিন কুমিল্লা চলে যান। ব্যাপারটা আন্দাজ করতে না পেরে সবাই মিলে কাজী নজরুল ইসলামের অন্তরঙ্গ গায়ক বন্ধু, শ্রী নলিনীকান্ত সরকারের শরণাপন্ন হন। নলিনীবাবুর কথাটা ছিল মোটামুটি এইরকম যে, *নজরুলের প্রাত্যহিক গতিবিধি ও কার্য্যসূচীর সন্ধান আগে থেকেই আমার জানা থাকতো। একদিন সারা বিকেলটা নজরুলের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে পরদিন সকাল বেলায় গিয়ে দেখি, নজরুল ঘরে নেই। তাঁর একজন সহকক্ষবাসী বন্ধু মোসলেম-ভারতের কর্ণধার, আফজালুল হক হাসতে হাসতে বললেন, *সে তো কাল রাত্তিরে কুমিল্লা চলে গেছে*।
তিনি বললেন,- *কৈ, কাল তো কিছু বললো না*। সহকক্ষবাসী বন্ধু বললেন,- *বলবে কি করে? কাল সন্ধ্যার পর এক ভদ্রলোক এসে কি সব কথাবার্তা বলে কুমিল্লা যাবার প্রস্তাব করলেন। প্রস্তাব, অনুমোদন, সমর্থন সব মুহূর্তের মধ্যে – সঙ্গে সঙ্গে শিয়ালদহ ষ্টেশনে যাত্রা*। ঐ *এক ভদ্রলোক* -এর নাম ছিল আলী আকবর খান, কুমিল্লার দৌলতপুরের এক বিখ্যাত প্রকাশক। যিনি সম্পর্কে নার্গিসের মামা ছিলেন।
সেই দৌলতপুর যাবার পথেই আলী আকবর খান সাহেব কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে কয়েকদিন কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে শ্রী ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে থেকে যান। ইন্দ্রকুমার বাবু কুমিল্লা বোর্ড অফ ওয়ার্ডস-এর ইন্সপেক্টর হিসেবে কাজ করতেন। ইন্দ্রকুমারের ছেলে বীরেন্দ্রকুমার, কুমিল্লা জেলা স্কুলে পড়াশুনা করতেন। সে সময় আলি আকবর খানও সেখানে পড়তেন। সে হিসাবে আলী আকবর খান ছিলেন বীরেন্দ্র কুমারের ক্লাসমেট । আর এই ক্লাসমেট থেকেই তাঁরা দুই বন্ধু হয়ে গেছিলেন এবং পরস্পর পরস্পরের বাড়ীতে যাতায়াত করতেন । বীরেন্দ্রকুমারের বাড়ীতে স্ত্রী, বোন, ছেলে ও বাবা মা ছাড়াও আরো থাকতেন বিধবা জেঠি গিরিবালা দেবী ও তাঁর একমাত্র কন্যা আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে প্রমীলা দেবী।
প্রমীলার স্বর্গীয় পিতা, শ্রী বসন্তকুমার সেনগুপ্তের আদি নিবাস ছিল মানিকগঞ্জের তেহুতা গ্রামে। তিনি ত্রিপুরা সরকারের নায়েবের পদে চাকুরী করতেন। পিতার মৃত্যুর পর প্রমীলারা কুমিল্লায় কাকা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তর অর্থাৎ বীরেন্দ্রকুমারদের বাড়ীতে এসেই বসবাস করছিলেন।
সেখানে কিছু দিন থাকার পর আলি আকবর খান সাহেব কাজী নজরুলকে সঙ্গে নিয়ে নিজের বাড়ি দৌলতপুরে চলে যান। আলী আকবর খান সাহেবের দু’জন বিধবা বোন ছিলো। এক বোন আলী আকবর খানের সংসারের সর্বময়ী কর্ত্রী ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামের চেহারা ও আচার আচরণ ব্যবহার দেখে বিধবা বোনের ভাল লাগে। তখন থেকে তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে মায়ের মতো স্নেহ আদর যত্ন করতেন। কিন্তু অন্য বোনটি ঐ বাড়ীতে না থাকলেও কাছাকাছিই থাকতেন। সেই বোনের এক ছেলে ও এক মেয়ে ছিলো। মেয়েটি যুবতী ও বেশ সুন্দরীও ছিল। কাজী নজরুল এ বাড়ীতে আসার পর তাদের যাতায়াত বেশ বেড়ে যেতে থাকল। অনুমান , কবি নজরুলের বাঁশী ও মেয়েটির রূপ যৌবন পরস্পর পরস্পরকে আকৃষ্ট করেছিলো। ঐ মেয়েটির নাম সায়ীদা খাতুন ছিল ওরফে নার্গিস বেগম , এই নামটি কাজী নজরুল ইসলামই রেখেছিলেন সৈয়দা খাতুনের। এই ঘনিষ্ঠতা থেকেই কিছুদিনের মধ্যে কবি ও নার্গিসের বিয়ের কথা পাকাপাকি ও বিয়ের দিন ধার্য হয়ে যায়। কুমিল্লার সেই পল্লীগ্রাম থেকেই কাজী নজরুল ইসলাম ও আলী আকবর খান সাহেব মিলে নজরুলের বিয়ের খবর ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ পাঠান। মুস্কিল একটা হলো, একদিকে ব্যবসা সংক্রান্ত কারণে আলী আকবর খান সাহেবের উপর অনেকেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। অন্যদিকে কবি নজরুলের তখন কিশোরকাল, বয়স কম, সাথে ভীষণ সেন্টিমেন্টাল এবং স্থিতিশীল কোন আয় তখন তাঁর ছিলোও না। এই অবস্থায় বিয়ে করার বিরাট দায়িত্ব কাজী নজরুল কেমন করে পালন করবে , সেটা নিয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধব সহ হিতৈষীদের দারুণ উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। অথচ কেউ এর বিরোধিতা করার সাহসও পাচ্ছিলো না।
১৯২১ সালের ৫ জুন, তারিখে, কবি কাজী নজরুলের কুমিল্লা থেকে পাঠানো চিঠির জবাবে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় লেখেন,
*ভাই নুরু, যখন তুই স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে তাকে বরণ করে নিয়েছিস, তখন অবশ্য আমার কোন দুঃখ নেই। তবে একটা কথা, তোর বয়স আমাদের চাইতে ঢের কম, অভিজ্ঞতাও তদনুরূপ feeling-এর দিকটা অসম্ভব রকম বেশী। কাজেই ভয় হয় যে, হয়তো বা দুইটা জীবনই না ব্যর্থ হয়। এ বিষয়ে তুই যদি concious, তাহলে অবশ্য কোন কথা নেই। যৌবনের চাঞ্চল্যে আপাতমধুর মনে হলেও ভবিষ্যতে না পস্তাতে হয়। তাই তুই নিজে যদি সব দিক ভেবে চিনতে বরণ করাই ঠিক করে থাকিস, তাহলে আমি সর্বান্তকরণে তোদের মঙ্গল কামনা করছি ।*
তুই লিখেছিস, *এক পল্লী বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি, যা কোন নারীর কাছে কখনো হইনি*। জেনে খুশী হলাম যে, তাঁর বাইরের ঐশ্বর্যও যথেষ্টই আছে। তুই যে এরূপ আজগুবি একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসবি, তা সকলে আমরা জানতুম*।
১৯২১ সালের ১৩ জুন কলকাতার *মোহাম্মদী* পত্রিকার অফিস থেকে সাহিত্যিক ওয়াজেদ আলী সাহেব লেখেন,–
*অভিন্ন হৃদয়েষু ভাই নজরুল, আপনার ৭ তারিখের স্নেহমাখা চিঠিখানি আজ বিকালে পেয়ে কয়েকবার পড়েছি, আর অশান্তির মধ্যেও খুব হেসেছি। পল্লীর যে কুটীরবাসিনী দৌলতপুরের দৌলতখানার শাহজাদী বলাই বোধ হয় ঠিক, তার সাথে আপনার মনের মিল ও জীবনের যোগ হয়ে গেছে তাঁকে আমার শ্রদ্ধা ও প্রীতিপূর্ণ আদাব জানাবেন। আমার বোধ হইতেছে যে, আপনার বন্ধুরা অসন্তুষ্ট হইয়াছেন একটা কারণে। আপনি *নারায়ণে* *দহনমালা* লিখে নারীর কাছে ক্ষমা চাইলেন, আর তার পরেই এত সত্বর প্রেমের ফাঁদে ধরা পড়লেন। যৌবনের জোয়ার বড় সাংঘাতিক। তাকে ঠেলে রাখা বড় দায়। এ আমি স্বীকার করছি*। এরপর আবার কদিন পরেই ১৬ জুন তারিখে আবার লেখেন, –
–*ভাই নজরুল, আপনার আগের চিঠির জবাব আগেই দিয়েছি। আজ এই কতক্ষণ হইল, রবিবারের চিঠিটাও পেলাম। আপনার বিয়ের খবরটা তাড়াতাড়ি এই সপ্তাহের কাগজে বের করে দিয়েছি। কিন্তু ভয় নেই, আপনার শ্রীমতীর কোন নামই কাগজে ছাপা হয় নাই*।
১৯২১ সালের ২৫ শে জুন কলকাতা থেকে মুজফফর আহমেদ সাহেব লেখেন,-
–*ভাই কাজী সাহেব। ওয়াজেদ মিয়ার চিঠিতে জানলাম যে, ৩রা আষাঢ় তারিখেই আপনাদের বিবাহ হচ্ছে। সময় খুব সংকীর্ণ কাজেই আমার আর যাওয়া হচ্ছে না। তবে ভালোয় ভালোয় সব মিটে যাক, এ প্রার্থনা খোদার দরগাহে*।
পরম প্রীতিভাজনেষু কাজী সাহেব, আপনার পত্রাদি যে আর মোটেই পাওয়া যাইতেছে না, তার কারণ কি? খান সাহেবের নিমন্ত্রণপত্র পাইয়াছিলাম। পত্রখানা আপনারই মুসাবিদা করা দেখিলাম। পত্রের ভাষা দু’এক জায়গায় বড় অসংযত হইয়াছে। একটু যেন কেমন দাম্ভিকতা প্রকাশ পাইয়াছে। আপনার হাত দিয়া অমন লেখা বাহির হওয়া কিছুতেই ঠিক হয় নাই। আমার ভয় হইতেছে যে, খান সাহেবের সংশ্রবে থাকিয়া আপনি না শেষে দাম্ভিক হইয়া পড়েন। অন্যে বড় বলিলে গৌরবের কথা হয়, আর নিজেকে নিজে বড় বলিলে অগৌরবের মাত্রাই বাড়িয়া যায়। *মোহাম্মদী* পত্রিকাকে বিবাহের কথা ছাপিতে অনুরোধ করাটা ঠিক হইয়াছে কি? তাঁরা তো নিজ হইতেই এ খবর ছাপিতে পারিতেন। বাস্তবিক আমার প্রাণে বড় লাগিয়াছে বলিয়া এত কথা বলিলাম। এই নিমন্ত্রণপত্র আবার *অপূর্ব নিমন্ত্রণপত্র* শিরোনামে *বাঙালী* পত্রিকাতে মুদ্রিত হইয়াছে দেখিলাম। *বাঙালী*-কে এই নিমন্ত্রণপত্র কে পাঠাইল? আপনার অঙ্ক লক্ষ্মীকে এই অপরিচিতের বিনয়-সম্ভাষণ জানাইবেন*।
মুদ্রিত ঐ নিমন্ত্রণ পত্রটিতে নজরুলের পিতা মরহুম কাজী ফকির আহমদ সাহেবের পরিচয় দেওয়া হয় চুরুলিয়ার *আয়মাদার* বলে। আর কাজী নজরুল ইসলামকে *মুসলিম রবীন্দ্রনাথ* বলা হয়। সম্ভবত: এই দুটি কথা মুজফফর সাহেবকে ব্যথিত করেছিল। মুজফ্ফর সাহেব ২১শে জুন আলী আকবর সাহেবকে লেখেন,-
*খান সাহেব, বিবাহের নিমন্ত্রণপত্র পাইয়াছি, অবশ্য হইয়া যাওয়ার পরে। আগে পাওয়া গেলেও বোধ হয় স্ট্রাইকের জন্য যাওয়া তেমন সুসাধ্য হইত না। যাহা হউক আশা করি ভালোয় ভালোয় শুভ কাজ শেষ হইয়া গিয়াছে*।
তিনি গোয়ালন্দ–চাঁদপুর স্টিমার ও আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কর্মচারীদের স্ট্রাইকের কথাই এখানে বোঝাইতে চাচ্ছিলেন।
যাই হোক, এতকিছু করে যে বিয়ে, সেটা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। দৌলতপুরে আলি আকবর খান সাহেবের কিছু কিছু ব্যবহার কাজী নজরুলকে মানসিক ভাবে আঘাত করে। হবু বধূর কিছু আচরণও তাঁর কাছে দুর্ব্যবহার বলে মনে হয় কবি নজরুল ইসলামের।আলি আকবর খান অবস্থা সুবিধের নয় দেখে ও নিজের দোষ কাটাবার অভিপ্রায়ে বিয়েটা ভেঙ্গে দেবার ফন্দি আটেন এবং হঠাৎ করেই একটা নতুন প্রস্তাব এনে বলেন, বিয়ের-পরে কাজী নজরুল ইসলামকে দৌলতপুরেই থেকে যেতে হবে । যেটা খান সাহেবও জানেন যে কবি নজরুলের পক্ষে কোনমতেই এই কথা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
বিয়েতে কাজী নজরুল ইসলামের বিশেষ আমন্ত্রণে বিরজাসুন্দরী দেবীও নৌকাযোগে দৌলতপুরের বিয়ে বাড়ীতে আসেন এবং সঙ্গে সেনগুপ্ত পরিবারের আরো দশ বারো জন সদস্যও এসেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম যখন তাঁর ঐসব অপমানের কথা বিরজাসুন্দরীকে জানান, তখন তিনি এই বিয়ে না করার জন্য পরামর্শও দেন। কিন্তু এ বিয়ে উপলক্ষে অতো লোকজন উপস্থিত হয়ে গেছিল যে, তাই বিয়েটা ভেঙ্গে না দিয়ে যেভাবেই হোক কাজী নজরুল ইসলাম ঝামেলাটা চুকিয়ে ফেলার মনস্থ করেন এবং বিয়েটা শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন করেন, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়েটা হয়েছিল সত্য বলে কেউ কেউ লিখেগেছেন। তবে এই বিয়ে নিয়ে মতানৈক্য রয়ে গেছে। কিন্তু এই বিয়ে ইসলামী মতে হয়নি। অর্থাৎ তাঁদের দাম্পত্য মিলন সাধিত হয়নি। বিয়ের রাতেই প্রচণ্ড ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যেই কাজী নজরুল ইসলাম দৌলতপুর ত্যাগ করেন। মনে করা হয়েছে যে , কাজী নজরুল ইসলাম সেইদিন সেনগুপ্ত পরিবারের সঙ্গেই কান্দিরপাড়ে সেনগুপ্ত বাড়িতে এসে ওঠেন। সেই কান্দিরপাড় থেকেই কবি নজরুল দুইটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি লেখেন।
প্রথম চিঠিটি লিখেন , আলি আকবর খান সাহেবকে। সেখানে কাজী নজরুল ইসলাম *মামাশ্বশুর* না লিখে *বাবাশ্বশুর* বলে সম্বোধন করেন,-
*বাবা শ্বশুর, আপনাদের এই অসুর জামাই পশুর মতন ব্যবহার করে এসে যা কিছু কসুর করেছে, তা ক্ষমা করুন সকলে, অবশ্য যদি আমার ক্ষমা চাওয়ার অধিকার থাকে। এইটুকু মনে রাখবেন, আমার অন্তর-দেবতা নেহায়েত অসহ্য হয়ে না পড়লে, আমি কখনো কাউকে ব্যথা দিই না। অতএব আমিও আপনাদের মতোই মানুষ। আমার গণ্ডারের চামড়া নয়, কেবল সহ্যগুণটা কিছু বেশী। আমার মান অপমান সম্বন্ধে কাণ্ডজ্ঞান ছিল না বা *কেয়ার* করিনি বলে আমি কখনো এত বড় একটা অপমান সহ্য করিনি। যাতে আমার *ম্যানলিনেসে* বা পৌরুষে গিয়ে বাজে । যাতে আমাকে কেঊ কাপুরুষ, হীন ভাবতে পারে। আমি সাধ করে পথের ভিখারি সেজেছি বলে লোকের পদাঘাত সইবার মতন *ক্ষুদ্র আত্মা* -র অমানুষও হয়ে যাইনি। আপনজনের কাছ হতে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এত হীন ঘৃণা, অবহেলা আমার বুক ভেঙ্গে দিয়েছে।
বাবা, আমি মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। দোয়া করবেন আমার এ ভুল যেন দুদিনেই ভেঙে যায়। বাড়ির সকলকে দস্তুরমতো সালাম দোয়া জানাবেন। তাকেও ক্ষমা করতে বলবেন, যদি এ ক্ষমা চাওয়া ধৃষ্টতা না হয়।
আজ ইতি।
চীরসত্য স্নেহসিক্ত – নুরু*।
এরপর দ্বিতীয় চিঠিটা তিনি কলকাতায় মুজফ্ফর আহম্মেদকে লিখেন। সেই চিঠি পেয়ে মুজফ্ফর আহমেদ অনেক কষ্ট করে কুমিল্লা এসেছিলেন কারণ, তখন রেল ধর্মঘট চলছিল। তিনি এসেই কাজী নজরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়েই কলকাতায় ফেরত যান। এর অল্প কিছুদিন পরেই ৩/১ সি তালতলা লেনে মুজাফ্ফর আহমেদ সাহেবের বাড়ীতে থাকা অবস্থায় নজরুলের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। এরপর নজরুল প্রায় তিন বছর ধরে কয়েকবার কান্দিরপাড় গিয়েছিলেন। এরপর ১৯২৪ সালের ২৪শে এপ্রিল, কলকাতার ৬ নম্বর হাজি লেনে, আশালতা সেনগুপ্তা, ওরফে প্রমীলার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় অনেক ঝক্কি সামলে।
কাজী নজরুল ইসলামের স্ত্রী প্রমীলা দেবীর বয়স তখন ১৮ বছরের বেশ কম ছিল বলে অফিসিয়ালি হিন্দু মুসলমানের বিয়ে, অর্থাৎ সিভিল ম্যারেজ হতে পারেনি। অগত্যা ইসলামী মতেই বিয়েটি সম্পন্ন করতে হয়েছিল। এ জটিলতায় হিন্দু, মুসলনমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরাও চটে গিয়েছিলেন। আশালতা সেনগুপ্তার ওরফে দোলনার গায়ের রঙ চাঁপাকলির মতো ছিল বলে নজরুল তাঁর দ্বিতীয় কাব্যের নাম দিয়েছিলেন *দোলন চাঁপা*। দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দেবার পর থেকে প্রমীলা দেবী পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়ে বহুদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। কবি প্রায় তাঁর সর্বস্ব দিয়ে স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে থাকেন। অল্পদিনের মধ্যে দারুণ অসুস্থ হয়ে কি নজরুলও নিজে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। দীর্ঘ ৩৮ বছর সংসার করার পর, ১৯৬২ সালের ৩০শে জুন, শনিবার মাত্র ৫২ বছর বয়সে প্রমীলা দেবী কলকাতার পাইকপাড়ার বাড়িতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। সেই সময় কলকাতার মির্জাপুর স্ট্রীটে নজরুল পাঠাগার ছিল। সেখানে বাৎসরিক নজরুল জয়ন্তী হতো। ফাংশান শেষে দলবল মিলে পাইক পাড়ায় গিয়ে কাজী সাহেবদের দেখে আসার একটা অলিখিত রেওয়াজ ছিল ঐ এলাকার লোকজনের। ১৯৬১ সালের নজরুল জয়ন্তীর পর , অর্থাৎ প্রমীলা দেবীর মৃত্যুর ঠিক আগের বছর, এলাকার লোকজন পাইকপাড়ার বাসায় নজরুল দম্পতীকে পাশাপাশি খাটে শোওয়া অবস্থায় দেখতে পান।
অসুস্থ স্ত্রী প্রমীলা দেবীর মৃত্যুর পর কাজী নজরুল ইসলামের অনেকদিনের অভিলাষ অনুযায়ী কবিপত্নীর মৃতদেহটি কলকাতা থেকে চুরুলিয়া নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেই হাজী পাহালোয়ানের দরগার পাশে কবরস্থ করা হয়। প্রমীলা দেবী বাল্যকাল থেকেই সাহিত্য ও সঙ্গীতের ভীষণ অনুরাগী ছিলেন। প্রমীলা দেবীর কিছু কবিতা মাসিক *সওগাত* ও দ্বিমাসিক *সাম্যবাসী* তে ছাপা হয়। যতদিন পেরেছেন, ঐ অচল অবস্থাতেও তিনি নিজ হাতে স্বামীকে খাইয়ে দিয়েছেন। কবির ভক্ত ও বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে তিনি একান্ত আপনজনের মতো ব্যবহার করতেন। সাংসারিক অসচ্ছলতার মধ্যেও তিনি কাউকে অভুক্ত অবস্থায় ফেরত দেননি। কখনও বিমর্ষ থাকতে দেখা যায় নাই এবং তাঁর কোন অভিযোগও তিনি কোন দিন করেন নাই।
নার্গিস খানের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে কখনও ভুলতে পারে নাই। এতো অল্প বয়েসে *শ্যাম রাখি না কূল রাখি* -এর মতো বিভ্রান্তিকর অবস্থায় পড়ে, স্বামীর সঙ্গে ঔ রাত্রেই বাড়ী ছেড়ে চলে যাবেন, না পিতৃকুলের সম্মান রক্ষা করবেন, তা তিনি বুঝে উঠতে পারেন নাই। কিন্ত নার্গিস কখনো হাল ছাড়েন নাই। নিজেকে তৈরী করে নিতে ঢাকায় গিয়ে *কামরুন্নেছা গার্লস কলেজে* পড়াশুনা করেন নার্গিস।
নার্গিস *তাহমিনা*, *ধুমকেতু* ও *পথিক হাওয়া* নামে তিনটি উপন্যাস ও বেশ কটি টেক্সট বুক লিখেন। *তাহমিনা* *সোহরাব রুস্তম* উপন্যাসের অনুকরণে সেই লেখা হয়েছিল। তাহমিনাকে রেখে রুস্তম যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যান। দেখানো হয়েছে ঠিক তেমনই নজরুল নার্গিসকে রেখে চলে গিয়েছিলেন। নার্গিসের জীবন যেন তাহমিনার অনন্ত দুঃখ দুর্দশা ও বঞ্চনার ইতিহাস। নার্গিসের সব কটা উপন্যাসই কাজী নজরুল ইসলামকে ঘিরে ছিলো।
১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসের চার তারিখ নার্গিস দীর্ঘ ১৬ বছর প্রতীক্ষার পর আলি আকবর খান অর্থাৎ মামার বন্ধু, ময়মনসিংহবাসী প্রফেসর হেলালুদ্দিন ও মামাতো ভাই নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতার শিয়ালদহ হোটেলে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে শেষ সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে মিঃ ওয়াজেদ আলীও উপস্থিত ছিলেন। অতর্কিতে এঁদেরকে দেখে কাজী নজরুল ইসলাম ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন। প্রথমে দু’জনের কেউই কোন কথা বলতে পারেন নাই।একটু পরে ধাতস্থ হয়ে কাজী নজরুল ইসলাম নার্গিসকে বলেন, –
–*তুমি ঢাকা ফিরে যাও। আমি খুব সত্বর ঢাকায় আসছি, সেখানেই এর একটা সমাধান করবো*।
তিনি সাংসারিক অসচ্ছলতার নানান কথা সহ দুঃখ দুর্দশাময় ভবিষ্যতের কথাও বলেন। এও উল্লেখ করে বলেন যে,-
* প্রমীলা ও তার মা সংসারে নার্গিসকে কখনোই বরদাস্ত করবেন না। অবশ্য নার্গিসের ভাষায়, *সেই সত্বর আর কখনো আসেনি*।
পরবর্তীকালে নার্গিস, কাজী নজরুল ইসলামের ভক্ত ও ঘনিষ্ঠ কবি আজিজুল হাকিমকে বিয়ে করেছিলেন এবং ১৯৮৫ সালে, প্রায় ৮১ বছর বয়সে আমেরিকার এক ছোট্ট শহরে মারা যান। কবি নজরুলের সাথে আর কখনও নার্গিসের দেখা না হলেও কবি নজরুল ইসলাম, নার্গিসকে এক অবিস্মরণীয় পত্র লেখেন। এর কিছুটা অংশ নীচে তুলে দেওয়া হলো,-
*কল্যাণীয়েষু,
তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নববর্ষার নবঘন সিক্ত প্রভাতে। পনেরো বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ের এমনি বারিধারার প্লাবন নেমেছিল, তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো। এই আষাঢ় আমার কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে। যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দিই। তোমার উপর আমি কোন জিঘাংসা পোষণ করি না । এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি, আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা। কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি । তা দিয়ে তোমাকে দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমাণিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না। আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণরূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথমে দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলী দিয়েছিলাম, সে রূপ আজও স্বর্গের পারিজাত মন্দারের মতো চিরঅম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের আগুন বাইরের সেই ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি। আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষ রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে। তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি, বিশ্বাস করো, আমার অক্ষয় আশীর্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে। তুমি সুখী হও, শান্তি পাও, এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস কর, আমি তত মন্দ নই, এই আমার শেষ কৈফিয়ত।
ইতি-
নিত্যশুভার্থী,
নজরুল ইসলাম।* ******************************
সংগ্রহিত তথ্য নির্ভর