বিশেষ আচার অনুষ্ঠানের পর পটে আঁকা দেবী বড় ঠাকুরাণীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শতাব্দী প্রাচীন রাজবাড়ির পুজো শুরু হয়।

আবদুল হাই, বাঁকুড়াঃ বৃহস্পতিবার বিষ্ণুপুরে মল্ল রাজবাড়িতে তোপধ্বনির মধ্যে দিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে পুজো শুরু হয়ে গেল। এদিন সকালে বিশেষ আচার অনুষ্ঠানের পর পটে আঁকা দেবী বড় ঠাকুরাণীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শতাব্দী প্রাচীন রাজবাড়ির পুজো শুরু হয়। মাতার আগমনের বার্তা ভক্তদের কানে পৌঁছে দিতে এদিন তিনটি পর্যায়ে মোট ৯টি তোপ দাগা হয়। তা দেখতে উৎসাহীদের ভিড় জমে। রাজবাড়ির পুজো এবারে ১হাজার ২৮ বছরে পড়ল।
বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ পরিবারের সদস্য জ্যোতিপ্রকাশ সিংহঠাকুর বলেন, আমার পূর্ব পুরুষদের প্রথম রাজধানী ছিল জয়পুরের পদ্যুঘ্নগড়। ২৯তম মল্লরাজা জগত মল্ল বিষ্ণুপুরে শিকারে এসে গাছের তলায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। শিকারে গেলে তাঁর পোষা বাজপাখিকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। বিশ্রামের সময় আকাশে একটি বক দেখতে পেয়ে হাতে থাকা বাজপাখি উড়ে গিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হওয়ায় বাজপাখিটি মাটিতে পড়ে যায়। ওইদিন রাতে মা মৃণ্ময়ী রাজাকে স্বপ্নাদেশ দেন যে, আমি এখানকার মাটিতে রয়েছি। আমাকে প্রতিষ্ঠা কর। তারপর ৯৯৭খ্রিষ্টাব্দে রাজা সেখানেই দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। গঙ্গামাটির সেই বিগ্রহ আজও অক্ষত রয়েছে। সেই দেবী মূর্তিকেই পুজো করা হয়। তবে আগেকার জৌলুস না থাকলেও প্রচলিত পুজোর আচার অনুষ্ঠান একেবারে তিথি নক্ষত্র মেনে পালন করা হয়। এখানে দেবী দূর্গা তিনটি রূপে পুজিতা হন। বড়ঠাকুরানি মা কালী, মেজো ঠাকুরানী সরস্বতী রূপে এবং ছোট ঠাকুরাণী লক্ষ্মীরূপে পুজিতা হন। পটের বড়ঠাকুরানী রবিবার মূল মৃন্ময়ী মন্দিরে প্রবেশ করেন। মহালায়ার পরের দিন মেজো ঠাকুরানী একইভাবে পুজো ও শুদ্ধাচারের পর মন্দিরে প্রবেশ করবেন। এবং ষষ্ঠীতে দেবী ছোট ঠাকুরানী প্রবেশ করবেন। এছাড়াও আমাদের পুজোর বিশেষত্ব হল তৎকালিন সময়ে কলেরা মহামারি রূপে দেখা যেত। তাই আরোগ্য কামনায় নবমীর রাতে অন্ধকারের মধ্যে খচ্চরবাহিনীর পুজো হয়।
বিষ্ণুপুর রাজবাড়ির পুরোহিত তরুণ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, মল্ল রাজবাড়ির পুজো হয় নিজস্ব বলি নারায়নী পদ্ধতিতে। সেই সময়ের হাতে লেখা পুঁথি আজও অমলিন। যা পাঠ করেই সম্পূর্ণ করা হয় মল্লরাজপরিবারের পুজো। প্রথা অনুযায়ী জিতাষ্টমীর দিন বিকালে বিল্লবরণ অনুষ্ঠান হয়েছে। ওইদিন দেবী সারারাত বেলগাছে ছিলেন। বৃহষ্পতিবার সকালে স্থানীয় গোপালসায়রে স্নান করানোর পর পটের দেবী বড়ঠাকুরানীকে মন্ত্রের মাধ্যমে শুদ্ধাচারের পর মৃন্ময়ী মন্দিরে প্রবেশ করানো হয়।
রাজবাড়ি সূত্রে জানা গিয়েছে, আগেকার দিনে ঘটে ও পটে পুজো হত। তখনও মূর্তিপুজো প্রচলন হয়নি। তৎকালীন মল্লরাজাদের প্রধান সেনাবাহিনীর মধ্যে একজন ছবি আঁকতে খুব পছন্দ করতেন। তাঁর আঁকা ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে রাজপরিবারের পুজোয় তাঁকে পট আঁকার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি এবং পরবর্তীকালে তাঁর বংশধরেরা একইভাবে রাজবাড়ির পুজোয় পটের দেবী আঁকেন। এবং মূল প্রতিমা ছাড়াও রাজবাড়ির পুজোর অন্যতম আর্কষণ পটে আঁকা বড়ো, মেজো ও ছোট ঠাকুরানির পুজো। দুর্গাপুজোয় অষ্টমীর সন্ধি পুজো উপলক্ষে তোপধ্বনি দেখতে স্থানীয় মূর্চার পাহাড়ে হাজার হাজার দর্শনার্থী ভিড় জমান। এছাড়াও রাজবাড়ির পুজোর অপর বিশেষত্ব হল আগে মল্লরাজা অষ্টমীর দিনে সন্ধিপুজোয় রাজবাড়িতে থাকা অষ্টধাতু দিয়ে তৈরি বিশালাক্ষ্মী উগ্রচণ্ডা মূর্তি পুজোয় স্বর্ণচাপা ফুল দিয়ে রাজঅঞ্জলি দিতেন। তা সম্পূর্ণ হওয়ার পরে অন্যান্যরা অঞ্জলি দিতে পারতেন। সেই পরম্পরা মেনে বর্তমান রাজপরিবারের সদস্যরা প্রতি বছর একইভাবে অঞ্জলি দেন। দশমীর দিন ঘট বিসর্জনের পর নীলকন্ঠ পাখি ওড়ান উড়িয়ে এবং দইয়ের মধ্যে চ্যাং মাছ ছেড়ে পুজো সমাপ্তি করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *