টুসু পরব শুরু করার আগে জেনে নিই এর উৎপত্তি ।
কুড়মি মাহাতো সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে বারো মাসে তেরো পার্বণ । কুড়মি মাহাতোদের প্রধান উৎসব হলো করম পরব, জিতিআ পরব, টুসু পরব, বাঁদনা পরব, রহিন পরব, চইত পরব, ইত্যাদি । আসমের চা উপজাতিদের মধ্যে টুসু উৎসব একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব । পৌষ মাসের শেষ দিনে অর্থাৎ মকর সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত একটি লোক উৎসব । এটি মূলত নদীকেন্দ্রিক । জনশ্রুতি, ফসল কাটার আনন্দে কৃষি প্রধান সমাজের সাধারণ বিশ্বাস ও বিশ্বাসের একীভূত রূপ ।
এবার জানা যাক, কুড়মি কারা ?
কুড়মি বাংলাদেশ, নেপাল, মরিশাস এবং ভারতে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী। অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মত, কুড়মিদেরও নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব পরিচয়, সামাজিক রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান, সংস্কৃতি, বর্ণ পরিচয় এবং সামাজিক বৈচিত্র্য রয়েছে; যা তাদের একটি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী হিসেবে ধরা হয় । বেশির ভাগ কুড়মি জনগোষ্ঠী বসবাস করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া, ঝাড়্গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলা সহ ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও অসম রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ।
আগেই বলেছি টুসু উৎসব বা মকর পরব একটি লোকউৎসব । এই উৎসব বাংলা অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিনে শুরু এবং পৌষ সংক্রান্তি বা মকর-সংক্রান্তির পুণ্যলগ্নে শেষ । টুসু এক লৌকিক দেবী যাকে কুমারী হিসেবে কল্পনা করা হয় । যার জন্য প্রধানত কুমারী মেয়েরা টুসু পুজার প্রধান ব্রতী ও উদ্যোগী । পশ্চিম বঙ্গের উল্লিখিত জেলাগুলি ছাড়া ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পূর্ব সিংভূম, পশ্চিম সিংভূম, ধানবাদ, হাজারিবাগ জেলা ও সাঁওতাল পরগনা, রাঁচী এবং ওড়িশার মইয়ূরভঞ্জ, সুন্দরগড়, কেন্দুঝর জেলার কৃষিভিত্তিক উৎসব ।
‘টুসু’ নাম নিয়েও নানানজনের নানান মত । শ্রদ্ধেয় ড.বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতোর মতে, তুষ থেকে টুসু শব্দটি এসেছে । টুসু শব্দটি ধানের তুষের বাংলা শব্দ যা ‘তুশ’ থেকে এসেছে । সুতরাং নামকরণ নিয়েও একটা গ্রহণযোগ্য মত খুঁজে পাচ্ছি না । দেবী টুসুকে একটি অল্প বয়সী মেয়ে এবং মহা জাগতিক দেবী হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে । টুসু পুজার আচারগুলি মহিলারা উপজাতীয় ভক্তিমূলক গানের মাধ্যমে পালন করেন । দেবীর মূর্তিটি উৎসব শেষে সাধারণত ধামসা মাদোল নামক উপজাতীয় বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গীতের মাধ্যমে কাছাকাছি নদীতে বিসর্জন দেওয়ার রেওয়াজ । সেইসময় বিরাট মেলাও বসে ।
এবার দেখা যাক টুসু উৎসব পালনের নিয়ম নীতিগুলি ।
টুসু উৎসব সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত । এক মাসের ধাক্কা । যেটা জানা গেছে, সেটা হচ্ছে ধানের ক্ষেত থেকে এক গোছা নতুন আমন ধান মাথায় করে এনে খামারে পিঁড়িতে রেখে দেওয়া হয়। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো লাগিয়ে তাতে তুষ রাখে । তারপর তুষের ওপর ধান,বাছুরের গোবরের মণ্ড, দূর্বা ঘাস, চাল, আকন্দ, গাঁদা ফুলের মালা প্রভৃতি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগিয়ে পাত্রটিকে পিড়ি বা কুলুঙ্গীর ওপর বসানো হয় বা স্থাপন করা হয় । প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে টুসু দেবী হিসেবে পুজা করা হয় । পৌষ মাসের প্রতি সন্ধ্যায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে টুসু দেবীর নিকট তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতা সঙ্গীতের মাধ্যমে নিবেদন করেন ও দেবীর উদ্দেশ্যে চিঁড়ে, গুড়, বাতাসা, মুড়ি, ছোলা ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করেন । পৌষ মাসের শেষ চারদিন আবার চাঁউড়ি, বাঁউড়ি, মকর এবং আখান নামে পরিচিত । চাঁউড়ির দিনে গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা উঠোন গোবরমাটি দিয়ে নিকিয়ে পরিষ্কার করে । বাঁউড়ির রাত দশটা থেকে টুসুর জাগরণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে । মেয়েরা জাগরণের ঘর ফুল, মালা ও আলো দিয়ে সাজিয়ে তোলে । রাতে কিশোরী কুমারী মেয়েরা ছাড়াও গৃহবধূ ও বয়স্কা মহিলারাও টুসু গানে অংশগ্রহণ করেন । টুসু দেবীর ভোগ হিসেবে নানারকম মিষ্টান্ন, ছোলাভাজা, মটরভাজা, মুড়ি, জিলিপি ইত্যাদি নিবেদন করার রেওয়াজ ।
পৌষ সংক্রান্তি বা মকরের ভোরবেলায় মেয়েরা দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে টুসু দেবীকে বাঁশ বা কাঠের তৈরী রঙিন কাগজে সজ্জিত চতুর্দোলায় বসিয়ে নদী বা কাছাকাছি পুকুরে নিয়ে যান । সেখানে প্রত্যেক টুসু দল গান গাইতে গাইতে দেবীকে বিসর্জন করে থাকেন । টুসু বিসর্জনের পরে মেয়েরা নদী বা পুকুরে স্নান করে নতুন বস্ত্র পরিধান করেন ।
তাই টুসু উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ টুসু গান । এই গানের মূল বিষয়বস্তু লৌকিক ও দেহগত প্রেম । এই গান গায়িকার কল্পনা, দুঃখ, আনন্দ ও সামাজিক অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করে । কুমারী মেয়ে ও বিবাহিত নারীরা তাদের সাংসারিক সুখ দুঃখকে এই গানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন । গানের মাধ্যমে মেয়েলি কলহ, ঈর্ষা, অভীপ্সা, দ্বেষ, ঘৃণা স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেন । টুসু গানকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয় – ভনিতাযুক্ত ও ভনিতা বিহীন ।
পরিশেষে এটাই বলার, লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে টুসু উৎসব ও টুসু গান রাঢ় বাংলা ছাড়িয়ে পশ্চিম বঙ্গের অন্যত্রও আরও জনপ্রিয় হোক । (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত) ।
মো-৯৪৩৩৪৬২৮৫৪ / এ১০এক্স-৩৪, কল্যাণী
টুসু উৎসব নিয়ে দুটি কথা : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

Leave a Reply