বাল গঙ্গাধর তিলক ছিলেন একজন মহান ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষক, আইনজীবী ও নির্ভীক স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে অন্যতম এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের পথিকৃত। ব্রিটিশরা তাকে বলত “ভারতীয় অস্থিরতার জনক” এবং জনগণ ভালোবেসে তাকে “লোকমান্য” উপাধি দিয়েছিল, যার অর্থ—“জনগণ তাকে নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে”।
মহাত্মা গান্ধী তাঁকে “আধুনিক ভারতের জনক” বলে অভিহিত করেছিলেন। তিলক ছিলেন স্বরাজ বা “স্বশাসন”–এর প্রথম এবং সবচেয়ে জোরালো প্রবক্তা। তাঁর ঐতিহাসিক ঘোষণা “স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার এবং আমি তা অর্জন করব” আজও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রেরণাদায়ক স্লোগান হিসেবে উচ্চারিত হয়।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
তিলকের জন্ম ২৩ জুলাই ১৮৫৬ সালে, মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি জেলার একটি চিতপাবন ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাঁর পিতা গঙ্গাধর তিলক ছিলেন একজন সংস্কৃত পণ্ডিত এবং স্কুল শিক্ষক। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিলক সত্যভামাবাইকে (তাপিবাই) বিয়ে করেন। তিনি ১৮৭৭ সালে পুনের ডেকান কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরে ১৮৭৯ সালে সরকারি আইন কলেজ থেকে এলএলবি (L.L.B) ডিগ্রি অর্জন করেন।
শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার
তিলক ছিলেন একজন অসাধারণ শিক্ষক ও সমাজ সংস্কারক। গোপাল গণেশ আগরকার, বিষ্ণুশাস্ত্রী চিপলুঙ্কর প্রমুখদের সঙ্গে মিলে তিনি ১৮৮০ সালে ‘নিউ ইংলিশ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরে ‘ডেকান এডুকেশন সোসাইটি’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা হন। এই সোসাইটি ১৮৮৫ সালে ফার্গুসন কলেজ স্থাপন করে, যেখানে তিলক গণিত পড়াতেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল ভারতীয় সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদকে শিক্ষার মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া।
রাজনৈতিক জীবন ও চরমপন্থা
১৮৯০ সালে তিলক ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। তিনি মধ্যপন্থী কংগ্রেস নেতাদের নীতির বিরোধিতা করে চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন লালা লাজপত রায় ও বিপিন চন্দ্র পাল। এই ত্রয়ী “লাল-বাল-পাল” নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।
প্লেগ মহামারী ও কারাবরণ
১৮৯৬-৯৭ সালে পুনেতে প্লেগ মহামারীর সময় ব্রিটিশ শাসকের কঠোর পদক্ষেপ জনরোষ সৃষ্টি করে। তিলক তাঁর কাগজ ‘কেশরী’-তে ব্রিটিশ শাসকের সমালোচনা করে প্ররোচনামূলক লেখালেখি করেন। পরবর্তীতে প্লেগ কমিশনার র্যান্ড হত্যার ঘটনায় তিলককে অভিযুক্ত করা হয় এবং তাঁকে ১৮ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি তখন থেকেই জনমনে জাতীয় বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনে ভূমিকা
বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে তিলক স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হয়ে ওঠেন। তিনি মনে করতেন স্বদেশী ও বয়কট—একই মুদ্রার দুই পিঠ। দেশি পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতীয় অর্থনীতিকে মজবুত করার ওপর তিনি জোর দেন।
কারাবরণ ও সাহিত্যচর্চা
তিলক একাধিকবার ব্রিটিশদের হাতে কারাবরণ করেন। বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) ম্যান্ডালয় কারাগারে তিনি দীর্ঘদিন বন্দি ছিলেন। কারাগারেই তিনি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ‘ভগবদ গীতা’র উপর তাঁর বিখ্যাত ভাষ্য ‘গীতা রহস্য’ রচনা করেন।
ব্যক্তিত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি
তিলক ছিলেন ধর্মচেতনার সঙ্গে যুক্ত জাতীয়তাবাদী চিন্তাবিদ। তিনি বলতেন—
“ধর্ম এবং ব্যবহারিক জীবন আলাদা নয়। প্রকৃত চেতনা হলো দেশকে নিজের পরিবারের মতো করে দেখা। এরপর মানুষের সেবা এবং সবশেষে ঈশ্বরের সেবা।”
উপসংহার
বাল গঙ্গাধর তিলক ভারতের ইতিহাসে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদের অগ্রপথিক, যিনি রাজনৈতিক চেতনা, শিক্ষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে একসূত্রে গেঁথে ভারতীয়দের আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। আজও তাঁর আদর্শ, চিন্তাভাবনা ও আত্মত্যাগ আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়।
📚 তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য তথ্যভাণ্ডার
Leave a Reply