অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্ত : মাস্টারদা সূর্য সেনের অকুতোভয় বিপ্লবী সাথিনী।

স্বাধীনতা সংগ্রামের এক সাহসিনী নারীর অনুপ্রেরণামূলক জীবনকথা


✦ ভূমিকা

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বহু নারীর অবদান রয়েছে, তবে যাঁরা সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের সংখ্যা খুবই কম। কল্পনা দত্ত ছিলেন সেই বিরল নারী যোদ্ধাদের একজন, যিনি ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে তিনি ছিলেন একজন সাহসী যোদ্ধা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁকে ‘অগ্নিকন্যা’ বলে অভিহিত করেছিলেন।


✦ জন্ম ও শৈশব

কল্পনা দত্তের জন্ম ১৯১৩ সালের ২৭ জুলাই চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার শান্ত পাহাড়ঘেরা গ্রাম শ্রীপুরে। বাবা বিনোদবিহারী দত্ত এবং মা শোভন বালা দত্ত। তিনি ছিলেন এক অসাধারণ মননের মেয়ে—সহানুভূতিশীল, কল্পনাপ্রবণ ও সমাজ সচেতন।


✦ শিক্ষা ও বিপ্লবী ভাবনার সূচনা

ডা. খাস্তগীর গার্লস স্কুলে পড়াশোনা করেন, যেখানে তার সিনিয়র ছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। দুজনেই প্রতিটি শ্রেণিতে প্রথম অথবা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করতেন। ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন এবং বিপ্লবী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রসংগঠনে যুক্ত হন।


✦ মাস্টারদা সূর্য সেনের সংস্পর্শ ও বিপ্লবী যাত্রা

১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে ফিরে এসে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের মাধ্যমে মাস্টারদার সংস্পর্শে আসেন। মাস্টারদা তখন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির নেতা। কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে দলের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেন। নারী হিসেবে বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান সে সময়ে বিরল হলেও মাস্টারদা সাহসিকতার সঙ্গে তা সমর্থন করেন।


✦ সশস্ত্র আন্দোলন ও ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ

কল্পনা দত্ত বিস্ফোরক বহন ও তৈরি করতেন। তিনি কোর্ট ও জেল ভাঙার পরিকল্পনাও করেছিলেন। ১৯৩১ সালে প্রীতিলতার সাথে ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন। কিন্তু অভিযানের ঠিক আগেই পুরুষের ছদ্মবেশে ক্লাবে রেকি করতে গিয়ে ধরা পড়েন ও গ্রেপ্তার হন।


✦ গ্রেফতার, কারাবাস ও পরবর্তী জীবন

গ্রেপ্তার, জামিন ও আত্মগোপনের পর ১৯৩৩ সালে আবারও ধরা পড়েন। মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদার ফাঁসি পান। কল্পনা দত্তকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড।

১৯৩৯ সালে মুক্তি পাওয়ার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে অনার্সসহ স্নাতক হন। এরপর যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। ১৯৪৩ সালে কমিউনিস্ট নেতা পূরণচাঁদ যোশীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পরে দিল্লিতে বসবাস শুরু করে নারী আন্দোলন ও ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।


✦ দেশভাগ, নারী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা

স্বাধীনতার পর তিনি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে কাজ করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নানা ভাবে সহায়তা করেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে তিনি চট্টগ্রামে ফেরেন, বিপ্লবীদের সম্মাননা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।


✦ সাহিত্যচর্চা ও মৃত্যু

তিনি ‘চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান’ নামে একটি বই লেখেন এবং নিজের স্মৃতিকথাও রচনা শুরু করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার তিন হাজার পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যায়। এই বেদনায় ১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, ৮২ বছর বয়সে দিল্লিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।


✦ উপসংহার

কল্পনা দত্ত শুধু একজন বিপ্লবীই ছিলেন না, ছিলেন নারী জাগরণের প্রতীকও। তাঁর অসীম সাহস, আত্মত্যাগ ও আদর্শ আজও নতুন প্রজন্মের জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণা।


তথ্যসূত্র: সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *