সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানা: আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নে বাংলাদেশের প্রথম নারী পাইলটের অমর গাথা।

৫ আগস্ট—এই দিনটি শুধু একটি তারিখ নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ব্যথাবেদনাময় অধ্যায়ের স্মারক। এই দিনে আমরা হারিয়েছিলাম দেশের প্রথম নারী পাইলট, সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানাকে—এক সাহসিনী, যিনি রক্ষণশীল সমাজের প্রাচীর ভেঙে নিজের ডানায় ভর করে ছুঁয়েছিলেন আকাশ। হয়েছিলেন বাংলাদেশ তথা মুসলিম বিশ্বের প্রথম নারী বৈমানিক, একজন আদর্শ ও অনুপ্রেরণা।

✈️ প্রজাপতির মতো ওড়ার স্বপ্ন

১৯৫৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেওয়া রোকসানার ডাকনাম ছিল ‘তিতলী’—যার অর্থ প্রজাপতি। সেই নাম যেন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিল। সবার মতো নয়, তিনি চেয়েছিলেন জীবনকে উপভোগ করতে নীল আকাশে উড়তে উড়তে। রক্ষণশীল সমাজের প্রাচীর ডিঙিয়ে, নিজ গুণ, অধ্যবসায় ও সাহসিকতা দিয়ে গড়েছিলেন নিজের উড়ানের পথ।

📚 প্রতিভা ও পথচলার শুরু

তিনি ছিলেন জার্মান ভাষায় ডিপ্লোমাধারী, রেডিও ও টেলিভিশনের সংগীতশিল্পী এবং জার্মানির মেডিক্যাল স্কলারশিপধারী। কিন্তু এই উজ্জ্বল সম্ভাবনাগুলোর মধ্যেও তিনি বেছে নেন পাইলট হওয়ার পথ। ১৯৭৬ সালে যোগ দেন বাংলাদেশ ফ্লাইং ক্লাবে। ১৯৭৮ সালে লাভ করেন কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স ও সহ-প্রশিক্ষকের স্বীকৃতি। এরপর শুরু হয় আকাশপথে তার নতুন জীবন।

🛫 ইতিহাসে প্রথম নারী পাইলট

১৯৭৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর, রোকসানা নিয়োগ পান বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে পাইলট হিসেবে—যেটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীদের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তিনিই ছিলেন দেশের সামরিক ইতিহাসে প্রথম নারী, যিনি ‘সোর্ড অব অনার’ লাভ করেছিলেন। ৬ হাজার ঘণ্টার বেশি ফ্লাইট সময়, অসংখ্য সহ-প্রশিক্ষণের কাজ—সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন এক অগ্রদূত, যিনি নারীদের আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নকে বাস্তব করে তুলেছিলেন।

🌧️ মর্মান্তিক পরিণতি

দুঃখজনকভাবে, সেই ডানামেলা জীবনের সমাপ্তি ঘটে মাত্র ২৮ বছর বয়সেই। ১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট, প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে অবতরণের চেষ্টা করতে গিয়ে যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত কারণে বিধ্বস্ত হয়। সেদিনের সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান রোকসানা সহ ৪৯ জন। তাদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটিশ ও জাপানি নাগরিকও।

🕊️ রেখে গেলেন চিরন্তন প্রেরণা

মাত্র সাড়ে ২৮ বছরের জীবনকালেও রোকসানা যা করে গেছেন, তা বাঙালি নারী সমাজের জন্য এক আলোকবর্তিকা। তার স্মৃতিকে অম্লান রাখতে ১৯৮৫ সাল থেকে ‘রোকসানা ফাউন্ডেশন’-এর উদ্যোগে প্রকাশিত হতে শুরু করে মাসিক রোকসানা পত্রিকা।
তিনি প্রমাণ করে গেছেন—স্বপ্ন দেখলে, সাহস থাকলে, সমাজের সীমাবদ্ধতাও হার মানে।
আজকের এই দিনটিতে শ্রদ্ধা জানাই সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানাকে—বাংলাদেশের আকাশপথের প্রথম নারী সেনানী, যিনি মৃত্যুকে পেরিয়ে হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের অবিনাশী চিহ্ন।
📚 তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *