যাত্রার শুরু: শিলিগুড়ির সকাল
শিলিগুড়ি, উত্তরবঙ্গের প্রধান প্রবেশদ্বার, পাহাড়ি সফরের এক স্বাভাবিক সূচনা বিন্দু। শীতের এক হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে আমরা যাত্রা শুরু করি। শহরের ভিড় পেরিয়ে, যখন গাড়ি সেভক রোড ধরে এগোতে থাকে, তখন তিস্তার রূপ চোখে ধরা দেয়। নদীর দু’পাশে সবুজ পাহাড়ের প্রহর, মাঝে মাঝে চা-বাগানের গন্ধ বাতাসে ভেসে আসে।
সেভক ব্রিজ ও তিস্তা নদী
সেভক ব্রিজের কাছে পৌঁছে প্রথমবার পাহাড়ি সফরের আসল রূপ দেখা দেয়। গাঢ় নীলচে সবুজ তিস্তা নদী পাহাড় কেটে বয়ে চলেছে, আর দূরে সান্দাকফুর মতো পাহাড়চূড়া মেঘের আড়ালে। সেভক থেকে রংপো পর্যন্ত রাস্তা হলো এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা—এক পাশে পাহাড়, আরেক পাশে খরস্রোতা নদী।
পথে ছোট ছোট দোকান, যেখানে গরম চা ও মোমো পাওয়া যায়। আমরা থেমে এক কাপ লাল চা (লেপচা চা) খাই, যার স্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে।
সিকিম প্রবেশদ্বার: রংপো
প্রায় দেড় ঘণ্টার ড্রাইভের পর পৌঁছাই রংপোতে—সিকিমের প্রবেশদ্বার। এখানে গাড়ির পারমিট চেক হয়, কারণ সিকিমে প্রবেশের জন্য অনেক জায়গায় বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়। রংপো থেকেই পাহাড়ি রাস্তার বাঁক বেড়ে যায়, আর প্রতিটি বাঁক যেন নতুন দৃশ্যপট খুলে দেয়।
তিস্তার বাঁক আর পাহাড়ি গ্রাম
রংপো পেরিয়ে রাস্তা কখনো পাহাড়ের গা ঘেঁষে উপরে উঠে যায়, কখনো নিচে নেমে যায় নদীর ধারে। তিস্তার পানির রঙ এখানে আরও উজ্জ্বল। মাঝে মাঝে দেখা মেলে পাহাড়ি গ্রামের—ছোট কাঠের বাড়ি, টিনের ছাদ, উঠানে গাঁদা ফুল আর বাঁশের বেড়া। গ্রামের মানুষরা হাসিমুখে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানায়।
সিংতাম ও রুমটেকের পথে
গ্যাংটকের দিকে যেতে সিংতাম নামের একটি জায়গা পড়ে, যেখান থেকে রুমটেক মঠের রাস্তা বেরিয়েছে। রুমটেক সিকিমের অন্যতম বিখ্যাত বৌদ্ধ মঠ, কার্মাপার আসন। যদিও আমাদের সফরের সময় রুমটেক সরাসরি যাওয়া হয়নি, কিন্তু দূর থেকে পাহাড়ের গায়ে বসে থাকা সোনালি ছাদের ঝলক দেখা গিয়েছিল।
গ্যাংটকের পথে শেষ কয়েক কিলোমিটার
শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক প্রায় ১২০ কিলোমিটার, কিন্তু পাহাড়ি রাস্তার কারণে সময় লাগে ৪–৫ ঘণ্টা। শেষ কয়েক কিলোমিটারে পাহাড়ি বন ঘন হয়ে আসে, বাতাস আরও শীতল। ছোট ছোট ঝর্ণা রাস্তার ধারে পড়ে, আর পাখিদের ডাক শোনা যায় স্পষ্টভাবে।
গ্যাংটকে প্রবেশ
গ্যাংটক শহরে ঢোকার আগে তিস্তার উপর দিয়ে শেষবারের মতো একটি সেতু পার হতে হয়। তারপরই শহরের প্রথম ঝলক—উচ্চতায় বসে থাকা রঙিন বাড়ি, রেলিং ঘেরা রাস্তা, আর দূরে বরফঢাকা পাহাড়। সন্ধ্যা নেমে আসছিল, আর পাহাড়ি বাতাসে এক ধরনের উৎসবের গন্ধ ছিল।
গ্যাংটকের রাত
গ্যাংটকের এমজি মার্গে রাতের আলোর রঙ অপরূপ। এখানে গাড়ি চলাচল নেই, শুধুই পথচারীদের জন্য। দুই ধারে দোকান, ক্যাফে, পাহাড়ি পোশাক ও হস্তশিল্পের স্টল, আর পর্যটকদের ভিড়। এক বাটি থুকপা আর গরম কফি খেয়ে রাতটা যেন পূর্ণতা পেল।
পরদিনের অভিযাত্রা
গ্যাংটক থেকে পরের দিন আমরা ছুটে গেলাম তাশি ভিউ পয়েন্টে, যেখানে ভোরের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘার অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়। পাহাড়ের উপরে লেগে থাকা মেঘের ফাঁক দিয়ে সোনালি আলো পড়ছিল—এমন দৃশ্য জীবনে একাধিকবার পাওয়া যায় না।
এরপর হানুমান টক, গণেশ টক, এবং বানঝাকরি ওয়াটারফল—প্রতিটি জায়গার নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। পাহাড়ি ঝর্ণার কাছে দাঁড়িয়ে বরফঠান্ডা পানির ফোঁটা মুখে লাগার অনুভূতি সত্যিই অন্যরকম।
সংস্কৃতি ও মানুষ
গ্যাংটকের মানুষ শান্ত, অতিথিপরায়ণ এবং হাসিখুশি। এখানে লেপচা, ভুটিয়া, নেপালি—বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে থাকে। শহরে বৌদ্ধ মঠের প্রার্থনা ঘণ্টা আর তিব্বতি পতাকার রঙিন দোল এক অন্য আবহ তৈরি করে।
ফেরার পথ
ফেরার পথে একই রাস্তা হলেও দৃশ্যপট আলাদা লাগছিল। হয়তো মন তখন পাহাড়ের মায়ায় আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। শিলিগুড়িতে ফেরার সময় একরাশ স্মৃতি আর পাহাড়ি হাওয়ার স্বাদ বুকে বয়ে নিয়ে এসেছিলাম।
উপসংহার
শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক সফর কেবল পাহাড়ি ভ্রমণ নয়—এটি এক আত্মার যাত্রা, যেখানে প্রকৃতি, মানুষ, আর সংস্কৃতি মিলে এক অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরি করে। প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি দৃশ্য যেন বলে—পাহাড়ে ফিরে এসো আবার।
Leave a Reply