গুয়াহাটি ও কমাখ্যা মন্দির: নীলাচলের বুকে দেবী শক্তির মহাতীর্থ।।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার বলা হয় আসামকে, আর সেই আসামের হৃদয়ে অবস্থিত গুয়াহাটি (Guwahati) শহর। ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে অবস্থিত এই শহর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় মহিমায় পরিপূর্ণ। গুয়াহাটির নাম শুনলেই প্রথমেই মনে আসে এক ঐশ্বর্যময় স্থানের নাম — কমাখ্যা মন্দির (Kamakhya Temple)। এটি শুধুমাত্র আসামের নয়, সমগ্র ভারতের এক প্রধান শক্তিপীঠ ও অন্যতম পবিত্র তীর্থস্থান।


🕉️ কমাখ্যা মন্দিরের ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনি

নীলাচল পর্বতের ওপরে অবস্থিত কমাখ্যা মন্দির হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী ৫১টি শক্তিপীঠের অন্যতম। কাহিনি অনুযায়ী, মহাদেবের পত্নী সতী আত্মাহুতি দেওয়ার পর তাঁর দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যখন ভগবান বিষ্ণুর চক্রে কেটে বিভিন্ন স্থানে পড়ে, তখন সতীর যোনি অংশটি নাকি এই স্থানেই পতিত হয়। সেই থেকেই এই স্থানকে “কমাখ্যা” বলা হয়, অর্থাৎ কাম-দেবীর আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক।

মন্দিরটি মূলত তন্ত্রসাধনার কেন্দ্র হিসেবেও খ্যাত। বলা হয়, দেবী এখানে মাতৃরূপে অবস্থান করেন এবং নারীশক্তির প্রতীক হিসেবে পূজিত হন।


🛕 স্থাপত্য ও মন্দিরের সৌন্দর্য

বর্তমান মন্দিরের স্থাপত্যে রয়েছে প্রাচীন নগর শৈলীবঙ্গীয় শৈলীর সমন্বয়। মূল গর্ভগৃহটি অন্ধকার ও রহস্যময়, যেখানে দেবীর প্রতীক রূপে একটি যোনি-আকৃতির পাথর রয়েছে, যা সর্বদা একটি ভূগর্ভস্থ ঝর্ণার জলে ভেজা থাকে। দেবীর কোনো মূর্তি নেই — এখানেই এই মন্দিরের এক অনন্যতা।

মন্দিরের চূড়ায় লাল রঙের গম্বুজ, পাথরে খোদাই করা বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, ও আশেপাশের প্রাচীন স্থাপত্য যেন অতীতের মহিমার সাক্ষী বহন করে।


🌸 অম্বুবাচী মেলা: নারীশক্তির পবিত্র উৎসব

প্রতি বছর জুন মাসে এখানে অনুষ্ঠিত হয় বিখ্যাত অম্বুবাচী মেলা। এই সময় দেবী কমাখ্যা-কে ঋতুমতী রূপে দেখা হয়, এবং মন্দির তিন দিন বন্ধ থাকে। চতুর্থ দিনে মন্দির খুললে হাজার হাজার ভক্ত ও তান্ত্রিক ভক্তরা দেবীর দর্শনের জন্য ভিড় জমায়। এই উৎসব আসামের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ।


🌄 গুয়াহাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

কমাখ্যা মন্দির শুধু ধর্মীয় দিক থেকে নয়, প্রাকৃতিক দিক থেকেও এক মনোমুগ্ধকর স্থান। মন্দির থেকে নিচে তাকালে ব্রহ্মপুত্র নদীর বিশালতা চোখে পড়ে, আর সূর্যাস্তের সময় নদীর রঙিন জল যেন এক অপার্থিব দৃশ্য উপহার দেয়।

গুয়াহাটি শহরেও রয়েছে আরও অনেক দর্শনীয় স্থান — যেমন উমানন্দ দ্বীপ (মহাদেবের মন্দির সহ), আসাম স্টেট মিউজিয়াম, আসাম চিড়িয়াখানা, বসিষ্ঠ আশ্রম, সুক্রেশ্বর ঘাট, নাভাগ্রহ মন্দির ইত্যাদি। শহর জুড়ে পাহাড় ও নদীর সংমিশ্রণ এক অনন্য শান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে।


🚗 যাত্রাপথ ও ভ্রমণ অভিজ্ঞতা

গুয়াহাটি পৌঁছানো একদমই সহজ। ভারতের বিভিন্ন শহর থেকে সরাসরি ট্রেন ও ফ্লাইটে পৌঁছানো যায় লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদলই বিমানবন্দরে। গুয়াহাটি রেলওয়ে স্টেশন থেকেও নীলাচল পর্বতে ট্যাক্সি বা অটো রিকশায় পৌঁছানো যায়।

মন্দিরে পৌঁছে প্রায় ৬০০ ফুট উঁচু পথে উঠতে হয়, তবে এখন সিঁড়ি ও যানবাহনের ব্যবস্থা আছে। উঠতে উঠতে রাস্তার দু’ধারে দোকানপাট, ফুলবিক্রেতা, ভক্তদের প্রার্থনা— সব মিলিয়ে এক পবিত্র আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হয়।


🪔 আশেপাশের দর্শনীয় স্থান

  • উমানন্দ মন্দির – ব্রহ্মপুত্র নদীর মাঝে এক ক্ষুদ্র দ্বীপে অবস্থিত মহাদেবের মন্দির।
  • বসিষ্ঠ আশ্রম – ঋষি বসিষ্ঠের তপোবনের স্মৃতি বহনকারী স্থান।
  • আসাম স্টেট মিউজিয়াম – আসামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক অনন্য ভাণ্ডার।
  • সুক্রেশ্বর ঘাট – সূর্যাস্ত দেখার আদর্শ স্থান।
  • পোবিতোরা বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য – একশৃঙ্গ গণ্ডারের জন্য বিখ্যাত, গুয়াহাটির কাছেই অবস্থিত।

🧘‍♀️ আধ্যাত্মিক শান্তি ও অনুভব

কমাখ্যা মন্দিরের পরিবেশে এক রহস্যময় শক্তি বিরাজমান। এখানে এসে যেন মন স্বয়ংক্রিয়ভাবে শান্ত হয়ে যায়। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, দেবী কমাখ্যা তাঁদের ইচ্ছাপূরণ করেন এবং অন্তরের সমস্ত অন্ধকার দূর করেন। তন্ত্রসাধকদের জন্যও এটি এক গভীর সাধনাক্ষেত্র।


🌼 উপসংহার

গুয়াহাটি ও কমাখ্যা মন্দির কেবল একটি ধর্মীয় স্থান নয় — এটি নারীশক্তির প্রতীক, ভক্তির কেন্দ্র, এবং প্রকৃতির স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মন্দির। ব্রহ্মপুত্রের কলতানে, মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনিতে, আর পাহাড়ি হাওয়ার মৃদু ছোঁয়ায় আপনি অনুভব করবেন এক অতুলনীয় পবিত্রতা।

যে কেউ যদি জীবনে একবারও দেবী শক্তির সত্য অনুভব করতে চান, তাঁর জন্য নীলাচলের এই মন্দির এক অপরিহার্য তীর্থক্ষেত্র।
কমাখ্যা শুধুমাত্র এক দেবী নয় — তিনি নারী, তিনি সৃষ্টি, তিনি চেতনা।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *