🌺 আসামের তেজপুর — ব্রহ্মপুত্র তীরে প্রেম, ইতিহাস ও প্রাকৃতির এক সুরেলা মেলবন্ধন 🌺
আসাম রাজ্যের বুকের মাঝে, ব্রহ্মপুত্র নদীর পাড়ে যেন এক অনিন্দ্যসুন্দর কবিতার মতো বসে আছে তেজপুর (Tezpur)। নামের অর্থই ‘রক্তের শহর’, তবে এই শহরের রঙ আজ সবুজ আর নীল — প্রকৃতির, ইতিহাসের ও সংস্কৃতির ছোঁয়ায় মুগ্ধ এক শহর। তেজপুরকে বলা হয় “আসামের সাংস্কৃতিক রাজধানী” — যেখানে প্রেমের কাহিনি, পৌরাণিক যুদ্ধ, প্রাচীন রাজবংশের স্মৃতি এবং আধুনিকতার ছোঁয়া একসাথে মিশে আছে।
🌿 পৌরাণিক কাহিনিতে তেজপুর
তেজপুরের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক অনন্য পৌরাণিক গল্প। কথিত আছে, উষা ও অনিরুদ্ধের প্রেমকাহিনি থেকেই এই শহরের জন্ম।
রাজা বাণাসুর, যিনি মহাদেবের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন, তাঁর কন্যা উষা প্রেমে পড়েন শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধের। এই প্রেমের কারণে ঘটে এক ভয়াবহ যুদ্ধ বাণাসুর ও কৃষ্ণের মধ্যে, যেখানে অনেকের প্রাণ যায়। সেই রক্তপাত থেকেই শহরের নাম হয় “তেজপুর” — ‘তেজ’ অর্থাৎ রক্ত, আর ‘পুর’ মানে শহর।
🏰 ঐতিহাসিক পরিচিতি
তেজপুর বহু রাজবংশের সাক্ষী। প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্যের উত্তরাধিকার এই অঞ্চল প্রাচীনকাল থেকেই সংস্কৃতি ও শিক্ষার কেন্দ্র ছিল। আহোম, গুপ্ত, পাল ও কামরূপ রাজাদের সময়ে এখানে অসংখ্য মন্দির, দুর্গ ও শিল্পস্থাপনা গড়ে ওঠে। বর্তমানে তেজপুর আসামের সবচেয়ে প্রাচীন শহরগুলির একটি।
🌺 তেজপুরের দর্শনীয় স্থান
🏞️ ১. অগ্নিগড় (Agnigarh)
ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে অবস্থিত এই পাহাড়টি উষা ও অনিরুদ্ধের প্রেমকাহিনির সাক্ষী। কিংবদন্তি মতে, বাণাসুর তাঁর কন্যাকে এখানে বন্দি করে রেখেছিলেন যাতে সে অনিরুদ্ধের সঙ্গে দেখা করতে না পারে। এখন অগ্নিগড় পাহাড়ের চূড়া থেকে দেখা যায় পুরো তেজপুর শহর ও ব্রহ্মপুত্রের মনোরম দৃশ্য।
🕉️ ২. মহাভৈরব মন্দির (Mahabhairab Temple)
শ্রীশৈল পর্বতের উপর অবস্থিত এই প্রাচীন মন্দিরটি মহাদেবের ভক্তদের অন্যতম পবিত্র স্থান। কথিত আছে, এখানে স্বয়ং শিবলিঙ্গ স্বপ্রকাশিত। প্রতি বছর মহাশিবরাত্রিতে হাজার হাজার ভক্ত এখানে সমবেত হন।
🌄 ৩. কলাক্ষেত্র (Cole Park / Chitralekha Udyan)
তেজপুরের অন্যতম সুন্দর পার্ক, যেখানে আছে শান্ত লেক, প্রাচীন ভাস্কর্য ও মনোমুগ্ধকর বাগান। সন্ধ্যাবেলায় পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর আদর্শ জায়গা এটি।
🐘 ৪. নামেরি ন্যাশনাল পার্ক (Nameri National Park)
তেজপুর থেকে প্রায় ৩৫ কিমি দূরে এই অরণ্য আসামের জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডার। এখানে দেখা যায় হাতি, বাঘ, হরিণ, এবং শত শত পাখির প্রজাতি। রাফটিং, ট্রেকিং ও বন্যপ্রাণী দর্শনের জন্য এই জায়গা একেবারে উপযুক্ত।
🏞️ ৫. ব্রহ্মপুত্র নদীর ঘাট
ব্রহ্মপুত্রের ঘাটে বসে সূর্যাস্ত দেখা তেজপুর ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ। নীল জলের ওপর লালচে আলো যখন পড়ে, তখন মনে হয় প্রকৃতির ক্যানভাসে ঈশ্বর নিজেই তুলির টান টেনেছেন।
🌸 তেজপুরের সংস্কৃতি ও উৎসব
তেজপুরকে বলা হয় আসামের “সংস্কৃতির হৃদয়”। এখানেই জন্মেছেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক লক্ষ্মীনাথ বেজবোরুয়া, যাঁকে আসামি সাহিত্যের জনক বলা হয়। প্রতি বছর এখানে অনুষ্ঠিত হয় ব্রহ্মপুত্র উৎসব ও তেজপুর উৎসব, যেখানে সংগীত, নৃত্য, নাটক ও হস্তশিল্পের প্রদর্শনী হয়।
☀️ ভ্রমণের সেরা সময়
তেজপুর ভ্রমণের আদর্শ সময় অক্টোবর থেকে এপ্রিল। এই সময় আবহাওয়া মনোরম থাকে, পাখিদের কূজন আর ফুলের গন্ধে শহর ভরে ওঠে। বর্ষাকালে (জুন–সেপ্টেম্বর) যদিও প্রকৃতি সবুজে ভরে যায়, নদীর জল তখন প্রবল স্রোতে প্রবাহিত হয়, যা আবার এক ভিন্ন সৌন্দর্য এনে দেয়।
🚗 কীভাবে পৌঁছাবেন
- বিমানপথে: নিকটতম বিমানবন্দর Salonibari Airport, তেজপুর শহর থেকে প্রায় ৮ কিমি দূরে।
- রেলপথে: তেজপুর রেলওয়ে স্টেশন গुवাহাটি, নাগাঁও ও শিলচর থেকে সংযুক্ত।
- সড়কপথে: NH-715 ধরে গাড়িতে বা বাসে গुवাহাটি থেকে প্রায় ১৮০ কিমি দূরত্ব।
🏨 থাকার ব্যবস্থা
তেজপুরে বিভিন্ন বাজেট ও বিলাসবহুল হোটেল রয়েছে। Hotel KRC Palace, Hotel Luit, Brahmaputra Jungle Resort — সবই পর্যটকদের আরামদায়ক থাকার জন্য উপযুক্ত।
🌿 উপসংহার
তেজপুর এমন এক শহর যেখানে ইতিহাসের ছায়ায় প্রকৃতি গান গায়, পৌরাণিক প্রেমের গল্প জড়িয়ে থাকে প্রতিটি পাথরে, প্রতিটি বাতাসে। ব্রহ্মপুত্রের ঢেউ এখানে বলে যায় হাজার বছরের গল্প।
✨ “তেজপুরে গেলে মনে হয়, সময় যেন থেমে গেছে — কেবল নদীর স্রোত, পাহাড়ের হাওয়া আর প্রেমের গল্পই কথা বলে।” ✨












Leave a Reply