অরুণাচল প্রদেশের নাম শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে পাহাড়ে মোড়া প্রকৃতির অপরূপ রূপ, সাদা তুষারের আস্তরণে ঢাকা রাস্তা আর মেঘের আলতো ছোঁয়া। সেই রাজ্যেরই এক অনন্য রত্ন হলো সেলা পাস (Sela Pass)—যা যেন পৃথিবীর বুকে এক স্বর্গীয় প্রবেশদ্বার। এটি কেবল একটি গিরিপথ নয়, বরং ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে প্রকৃতির এক অনুপম বিস্ময়।
🏔️ অবস্থান ও উচ্চতা
সেলা পাস অরুণাচল প্রদেশের পশ্চিমাংশে, তাওয়াং-এর পথে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩,৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই গিরিপথ ভারতের অন্যতম উঁচু মোটরচালিত রাস্তা। এটি তাওয়াং জেলাকে বাকি অরুণাচল প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
গুয়াহাটি বা তেজপুর থেকে তাওয়াং যাওয়ার পথে এই সেলা পাস পড়ে, তাই প্রায় সব পর্যটকই এই মনোরম স্থানটি পেরিয়ে যান।
❄️ প্রকৃতির স্বর্গসদৃশ রূপ
সেলা পাসে পৌঁছনোর পরই প্রথম চোখে পড়ে বরফে ঢাকা রাস্তা ও দূরের তুষারাচ্ছন্ন শৃঙ্গগুলো। মনে হয় যেন মেঘের মধ্যে দিয়ে চলেছে গাড়ি।
গিরিপথের কাছে রয়েছে বিখ্যাত সেলা লেক (Sela Lake) — স্থানীয়রা একে “স্বর্গের দরজা” বলে ডাকেন। নীলাভ জলের উপর বরফের আস্তরণ, আর চারপাশে প্রার্থনার রঙিন পতাকা—দৃশ্যটি এতই অপার্থিব যে মনে হয়, পৃথিবীর নয়, কোনো অন্য জগতের ছবি।
শীতকালে পুরো সেলা অঞ্চল সাদা তুষারে ঢেকে যায়। গাছপালা, পাথর, গাড়ির ছাদ—সবকিছুই পরিণত হয় তুষারের ভাস্কর্যে। আর গ্রীষ্মে বরফ গলে গেলে চারপাশে ফুটে ওঠে রঙিন বুনোফুল, যেন প্রকৃতির আঁকা এক ক্যানভাস।
🕊️ সেলা পাসের ইতিহাস ও নামকরণ
সেলা পাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক মর্মস্পর্শী কাহিনি। ভারত-চীন যুদ্ধের সময় (১৯৬২), এক ভারতীয় সৈনিক জস্বন্ত সিং রাওয়াত বীরত্বের সঙ্গে একাই চীনা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। তাঁর সহায়তায় ছিলেন এক মনপা উপজাতির নারী সেলা। যুদ্ধক্ষেত্রে জস্বন্ত সিং নিহত হন, আর শোকে সেলা আত্মহত্যা করেন।
তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই গিরিপথের নামকরণ করা হয়েছে “সেলা পাস”। আজও সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে, যা সেই আত্মত্যাগের প্রতীক।
🌸 প্রাণীকুল ও প্রকৃতি
সেলা পাসের আশপাশের অঞ্চল জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এখানে দেখা মেলে বিরল হিমালয়ান মোনাল পাখি, যা অরুণাচলের রাজপাখি হিসেবেও পরিচিত। কখনও কখনও তুষারচিতার (Snow Leopard) পদচিহ্নও দেখা যায়।
চারপাশের অরণ্যে পাইন, দেবদারু ও রডোডেন্ড্রন গাছের সারি প্রকৃতিকে আরও রূপময় করে তোলে।
🛣️ সেলা পাসে পৌঁছানোর পথ
সেলা পাসের যাত্রা নিজেই এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
- শুরু করুন: গুয়াহাটি বা তেজপুর থেকে।
- গন্তব্য: বমডিলা হয়ে তাওয়াং।
- দূরত্ব: প্রায় ৩২০ কিলোমিটার।
গুয়াহাটি থেকে গাড়িতে ১২-১৪ ঘণ্টা সময় লাগে, তবে পাহাড়ি রাস্তায় প্রতিটি বাঁকই যেন এক একটি নতুন দৃশ্য। শীতকালে বরফের কারণে রাস্তা প্রায়ই বন্ধ হয়ে যায়, তাই ভ্রমণের আগে আবহাওয়া সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন।
🏕️ থাকা ও খাওয়া
সেলা পাসে থাকার ব্যবস্থা খুব সীমিত, তবে কাছাকাছি দিরাং বা তাওয়াং শহরে আরামদায়ক হোটেল ও হোমস্টে রয়েছে।
স্থানীয় মনপা জনগণের আতিথেয়তা ভোলার নয়। এখানে থুকপা, মোমো, এবং গরম বাটার টি খাওয়া যেন ঠান্ডার মধ্যে স্বর্গীয় স্বাদ এনে দেয়।
🌈 সেরা ভ্রমণ সময়
সেলা পাস ভ্রমণের জন্য মার্চ থেকে মে এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বর শ্রেষ্ঠ সময়। শীতকালে (ডিসেম্বর–ফেব্রুয়ারি) বরফে রাস্তা ঢেকে যায়, কিন্তু যদি তুষার দেখতে চাও, এই সময়ই সবচেয়ে উপযুক্ত।
🌄 সেলা পাসের সৌন্দর্যের অনুভব
সেলা পাসে দাঁড়িয়ে যখন সূর্যোদয় দেখা যায়, তখন মেঘের সাগরের ওপর রোদ পড়ে সোনালি আভা ছড়ায়—যেন প্রকৃতির হাতে আঁকা এক স্বপ্ন। বাতাসে প্রার্থনার পতাকার মৃদু শব্দ, ঠান্ডার কামড় আর আকাশভরা নীল—সব মিলিয়ে সেলা পাস এক জাদুকরি অনুভূতি।
💫 শেষকথা
সেলা পাস শুধুই একটি পাহাড়ি গিরিপথ নয়—এটি এক যাত্রার প্রতীক, যেখানে প্রকৃতির কঠিন সৌন্দর্য মিশেছে মানবিক আত্মত্যাগের গল্পে।
যে কেউ একবার এখানে আসে, তার হৃদয়ে সেলা পাসের নীরবতা ও সাদা শান্তি চিরকাল বেঁচে থাকে।
সেলা পাস—প্রকৃতির কোলে, শান্তির ছায়ায়, এক সত্যিকারের স্বর্গের দরজা। ❄️🌸












Leave a Reply