কালিম্পং শহরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো জং ডগ পালরি ফোডং মঠ (Zang Dhok Palri Phodang Monastery)।

জং ডগ পালরি ফোডং মঠ – কালিম্পঙের আধ্যাত্মিক নীলাভ আশ্রয়। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর প্রান্তে, হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত শান্ত, সবুজ, মনোরম জেলা কালিম্পং। পাহাড়, মেঘ, চা-বাগান আর আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধনে সাজানো এই শহর বহু যুগ ধরে ভ্রমণপিপাসুদের মন জয় করেছে। এই কালিম্পং শহরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো জং ডগ পালরি ফোডং মঠ (Zang Dhok Palri Phodang Monastery) — এক অনন্য তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মকেন্দ্র, যা শান্তি, প্রার্থনা ও সৌন্দর্যের এক আশ্চর্য মিলনস্থল।


🕉️ মঠের পরিচয় ও ঐতিহ্য

জং ডগ পালরি ফোডং মঠকে অনেকেই কালিম্পং-এর “গুরু মঠ” নামেও চেনেন। এটি ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিব্বত থেকে নির্বাসিত হয়ে আসা দালাই লামা নিজ হাতে এর উদ্বোধন করেন। মঠটি তিব্বতের বিখ্যাত বৌদ্ধ মঠ “ফোডং”-এর প্রতিরূপ, যেখানে তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মের গেলুগপা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য অনুসরণ করা হয়।

এখানে সংরক্ষিত আছে তিব্বতের বহু মূল্যবান ধর্মগ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি, যার মধ্যে কিছু ১৪শ শতকেরও প্রাচীন। এই কারণে মঠটি শুধু আধ্যাত্মিক কেন্দ্র নয়, এটি এক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতিগত ঐতিহ্যের ভাণ্ডার


🏔️ যাত্রাপথ ও প্রথম দর্শন

কালিম্পং শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে, ডুরপিন পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই মঠ। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি এগোতে থাকে ধীরে ধীরে, আর রাস্তার দু’ধারে পাইন ও দেবদারু গাছের সারি যেন যাত্রীকে স্বাগত জানায়। উপরে উঠতে উঠতে হঠাৎ এক জায়গায় চোখে পড়ে সোনালি চূড়াওয়ালা এক মনোরম মঠ— সেটিই জং ডগ পালরি ফোডং।

প্রবেশদ্বারেই লাল, হলুদ ও নীল রঙে সজ্জিত তিব্বতীয় নকশার বিশাল দরজা, পাশে প্রার্থনার চাকা (Prayer Wheel), যা ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে ভেসে বেড়ায় “ওম মণি পদ্মে হুম”-এর সুমধুর মন্ত্রধ্বনি।


🕯️ মঠের ভিতরের সৌন্দর্য

মঠের ভিতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে অপূর্ব রঙিন প্রাচীরচিত্র— যেখানে অঙ্কিত বুদ্ধ, পদ্মসম্ভব, অর্য্যাবলোকিতেশ্বর এবং অন্যান্য বৌদ্ধ দেব-দেবীর চিত্র। পুরো পরিবেশে এক গভীর প্রশান্তি। ধূপের গন্ধে ভরে থাকে বাতাস, আর ভিক্ষুদের মৃদু প্রার্থনা যেন পাহাড়ের নীরবতাকে আরও গম্ভীর করে তোলে।

ভিতরের প্রার্থনাকক্ষে রয়েছে বিশাল বুদ্ধমূর্তি, যার সামনে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় প্রার্থনা হয়। ভিক্ষুরা ঘণ্টা ও ঢোল বাজিয়ে তিব্বতীয় ভাষায় পাঠ করেন, সেই সুরেলা ধ্বনি যেন মনকে এক নতুন স্তরে নিয়ে যায়।


🌄 দৃশ্যপট ও পরিবেশ

মঠটি যেহেতু ডুরপিন পাহাড়ের উপর অবস্থিত, তাই এখান থেকে দেখা যায় হিমালয়ের অপরূপ দৃশ্য, বিশেষ করে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতমালা। মেঘ যখন নিচে নেমে আসে, মনে হয় যেন স্বর্গ নেমে এসেছে পাহাড়ে।

দূরে দেখা যায় তিস্তা নদীর উপত্যকা, আশেপাশের বনাঞ্চল, আর নিচে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রাম। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় এই জায়গা একেবারে অলৌকিক হয়ে ওঠে— আকাশের রঙ, মেঘের ছায়া আর পাহাড়ের ছন্দে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে।


🙏 আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্র

জং ডগ পালরি ফোডং শুধু একটি দর্শনীয় স্থান নয়, এটি ধ্যান ও আত্মচিন্তনের স্থান। অনেক ভ্রমণকারী এখানে নিরিবিলি বসে ধ্যান করেন, মন্ত্রপাঠ শোনেন, অথবা নিঃশব্দে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকেন।

মঠের ভিক্ষুরা অত্যন্ত বিনয়ী ও অতিথিপরায়ণ। তারা তিব্বতীয় সংস্কৃতি, ধর্ম ও প্রার্থনা সম্পর্কে পর্যটকদের জানাতে আগ্রহী। ফলে এখানে এসে শুধু দর্শন নয়, এক আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভের সুযোগও মেলে।


🕊️ ভ্রমণের বিশেষ অভিজ্ঞতা

আমার নিজের অভিজ্ঞতায়, মঠের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন দূরে বরফঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল— জীবনের যত অশান্তি, ক্লান্তি সব যেন দূর হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি বাতাসের ছোঁয়া, প্রার্থনার ধ্বনি আর আকাশের নীল আলোয় ডুবে থাকা মঠ— এমন দৃশ্য যে কোনো মনকে শান্ত করে দেয়।


🛕 চারপাশের দর্শনীয় স্থান

জং ডগ পালরি ফোডং মঠের কাছেই রয়েছে—

  • ডেলো হিল – কালিম্পংয়ের সর্বোচ্চ পয়েন্ট
  • হানুমান টক – বিশাল হানুমান মূর্তি ও সুন্দর ভিউপয়েন্ট
  • কালিম্পং মার্কেট – পাহাড়ি হস্তশিল্প ও সুভেনিরের ভান্ডার
  • তিস্তা ভিউ পয়েন্ট – নদী ও উপত্যকার মুগ্ধকর দৃশ্য

সব মিলিয়ে এই অঞ্চলটি প্রকৃতি ও সংস্কৃতির এক মনোমুগ্ধকর সংমিশ্রণ।


🌺 সমাপ্তি

জং ডগ পালরি ফোডং মঠ কেবল একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি এক মানসিক শান্তির আশ্রয়স্থল। এখানে এসে বোঝা যায়— প্রকৃতির মাঝে থাকা, নীরবতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা, আর আত্মার শান্তি খুঁজে পাওয়াই আসল ভ্রমণের অর্থ।

যে কেউ একবার এই মঠে গেলে বুঝবে, কেন কালিম্পং কেবল পাহাড় নয়— এটি আত্মার পর্বত, আর জং ডগ পালরি ফোডং মঠ সেই আত্মার দরজা খুলে দেয় এক অপার শান্তির জগতে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *