পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ি সৌন্দর্যের রাজ্য দার্জিলিং জেলার প্রাক্তন অংশ এবং বর্তমানে স্বতন্ত্র জেলা কালিম্পং, তার নিভৃত, সবুজে ঘেরা পাহাড়, মেঘের ভেলা আর নীলচে আকাশের জন্য বিখ্যাত। এই কালিম্পং শহরের সর্বোচ্চ স্থান, যেখানে মেঘ এসে ছুঁয়ে যায় গাছের ডাল, বাতাসে মিশে থাকে পাহাড়ি ফুলের গন্ধ, আর চোখ যতদূর যায় ততদূর পর্যন্ত হিমালয়ের পর্বতমালা — সেটিই ডেলো হিল (Deolo Hill)।
🌄 পথচলা শুরু
সকালের ঠান্ডা হাওয়ায় ভোরবেলা আমি কালিম্পং শহর থেকে রওনা হলাম ডেলো পাহাড়ের পথে। শহরের ভেতর দিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে রাস্তা উপরে উঠছে। বাঁকানো পাহাড়ি রাস্তার দু’ধারে ঘন দেবদারু আর পাইনগাছের সারি, মাঝে মাঝে চা-বাগানের সবুজ ঢাল। প্রতিটি মোড়ে যেন প্রকৃতি নতুন রঙে সেজে উঠছে।
প্রায় ৮ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতেই দেখা মিলল সেই বহু প্রতীক্ষিত স্থান— ডেলো হিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫,৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই পাহাড় থেকে পুরো কালিম্পং শহর, তিস্তা নদীর উপত্যকা এবং দূরবর্তী কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত দেখা যায় স্পষ্টভাবে।
🌿 ডেলো পার্কের সৌন্দর্য
ডেলো হিলের উপরে রয়েছে সুন্দরভাবে সাজানো ডেলো পার্ক, যা একপ্রকার ফুলে মোড়া স্বর্গ। রঙিন ফুল, পরিষ্কার লন, পাথরের হাঁটার পথ, আর চারদিকে বিস্তৃত সবুজে মোড়া পাহাড়— সব মিলিয়ে এটি এক স্বপ্নরাজ্য। এখানে দাঁড়িয়ে চারদিকের পাহাড় দেখলে মনে হয়, আকাশ যেন হাতের নাগালে।
সকালবেলায় সূর্যের আলো পড়ে যখন কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারচূড়া সোনালী আভায় ঝলমল করে, তখন সেই দৃশ্য চোখে নয়, মনে গেঁথে যায় চিরদিনের জন্য।
🌤️ অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ
প্রকৃতিপ্রেমীদের পাশাপাশি ডেলো হিল এখন অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদেরও প্রিয় গন্তব্য। এখান থেকে প্যারাগ্লাইডিং করা যায় — যা ডেলোর অন্যতম আকর্ষণ। পাহাড়ের উপর থেকে উড়ে যাওয়া, নিচে সবুজ উপত্যকা, বয়ে চলা তিস্তা নদী, আর দূরে বরফঢাকা পর্বতশ্রেণি— সত্যিই অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
এছাড়াও রয়েছে ঘোড়ায় চড়া, স্থানীয় ট্রেকিং ট্রেইল, ছোট ক্যাফে ও ভিউ পয়েন্ট থেকে চা হাতে বসে পাহাড় দেখা — যা ভ্রমণকে আরও রোমাঞ্চকর করে তোলে।
🏡 বিশ্রাম ও থাকার ব্যবস্থা
ডেলো হিলের উপরে রয়েছে West Bengal Tourism-এর দারুণ একটি ট্যুরিস্ট লজ। এখানেই রাতে থাকা যায়। জানালার বাইরে মেঘ ভাসে, আর দূরে পাহাড়ে জ্বলে ওঠে ছোট ছোট গ্রামগুলোর আলোক বিন্দু। এমন নিস্তব্ধ, শান্ত পরিবেশে রাত কাটানো যেন এক আলাদা অভিজ্ঞতা।
সকালে ঘুম ভাঙে পাখির ডাক আর সূর্যের প্রথম আলোয় আলোকিত কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য দেখে।
🌺 চারপাশের দর্শনীয় স্থান
ডেলো হিল থেকে খুব কাছে রয়েছে—
- হানুমান টক — বিশাল হানুমান মূর্তিসহ দারুণ ভিউ পয়েন্ট
- ডুরপিন মনাস্ট্রি — শান্ত ও আধ্যাত্মিক বৌদ্ধ বিহার
- তিস্তা নদীর ভিউ পয়েন্ট
- কালিম্পং বাজার ও হস্তশিল্পের দোকান
এই সব মিলিয়ে একদিনে কালিম্পং ও ডেলো ভ্রমণ সম্পূর্ণ করা যায় সহজেই।
🌅 ডেলো হিলের সূর্যাস্ত
দিনের শেষে সূর্য যখন ধীরে ধীরে পাহাড়ের পেছনে ঢলে যায়, তখন পুরো আকাশ কমলা, লাল ও বেগুনি রঙে রাঙিয়ে ওঠে। মেঘের ফাঁকে আলো-ছায়ার খেলা, ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ, আর নিচের উপত্যকায় ঝিকমিক করা আলোর রেখা— এমন দৃশ্য কোনো ছবিতেও ধরা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।
💬 সমাপ্তি
ডেলো হিল শুধু একটি দর্শনীয় স্থান নয়, এটি এক আত্মার বিশ্রামস্থল। এখানে প্রকৃতি তার সবচেয়ে কোমল, শান্ত ও মনোমুগ্ধকর রূপে ধরা দেয়। যে কেউ একবার এখানে এলে, পাহাড়ের সেই নীরবতা, মেঘের ছোঁয়া আর সূর্যের সোনালী আলোয় ভেজা সকাল— চিরকাল মনে থেকে যায়।
ডেলো হিল যেন বলে ওঠে—
“যদি সত্যিকারের শান্তি খুঁজে পেতে চাও, তবে এসো পাহাড়ের কোলে, মেঘের মাঝে।”












Leave a Reply