বাংলার হৃদয়ভূমি বীরভূম জেলার অন্তরে অবস্থিত এক তীর্থধাম, যার নাম উচ্চারণ করলেই মনের গভীর থেকে শ্রদ্ধা ও ভক্তির স্রোত প্রবাহিত হয়— তারাপীঠ। এই পীঠস্থান শুধু এক দেবালয় নয়, এটি এক অলৌকিক আধ্যাত্মিক কেন্দ্র, যেখানে ভক্তি, তন্ত্র, সাধনা ও অলৌকিকতার অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটে। এই স্থানটি ভগবতী তারারূপিণী মা কালীকে নিবেদিত।
পথের শুরু
আমি যে দিন তারাপীঠের পথে রওনা হই, ভোরের সূর্য তখনও আকাশের কোলে উঠতে পারেনি। বোলপুর স্টেশন থেকে বাসে প্রায় ২ ঘণ্টার পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম রামপুরহাটে। সেখান থেকে অটো বা টোটো ধরে পৌঁছানো যায় তারাপীঠে। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি দোকান, শাঁখার ঝংকার, ধূপ-ধুনোর গন্ধ, আর “জয় তারা মায়” ধ্বনিতে মুখরিত বাতাস— এমন এক আবেশ তৈরি করে যা মনে করিয়ে দেয়, আপনি দেবীর আশ্রয়ে প্রবেশ করছেন।
মা তারার অলৌকিক মন্দির
তারাপীঠ মন্দিরের প্রধান আকর্ষণ মা তারার মূর্তি। দেবী এখানে মাতৃরূপিণী, দয়াময়ী, কিন্তু একই সঙ্গে তন্ত্রসাধনার দেবী। দেবীর রূপে দেখা যায়— তিনি আসীন আছেন শিবের বক্ষদেশে, যিনি মৃত অবস্থায় শায়িত। দেবীর চোখে করুণার গভীর ছোঁয়া, আবার শক্তির দীপ্তি। সোনালী মুকুটে শোভিত দেবী, গলায় রুদ্রাক্ষমালা, আর মুখে চিরন্তন হাসি— দর্শনের মুহূর্তেই মন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
মন্দিরের চারপাশে ভক্তদের ভিড় লেগেই থাকে। কেউ ফুল, কেউ নৈবেদ্য, কেউ শুধু ভক্তির অশ্রু নিবেদন করছে মায়ের চরণে। সকালে ও বিকেলে বিশেষ আরতি হয়, সেই সময়ে ভক্তি ও সংগীতের মেলবন্ধনে মন্দির চত্বরে সৃষ্টি হয় এক অপার্থিব আবহ।
মহাস্মশান ও বামাক্ষ্যাপা
তারাপীঠের অপর নাম “তান্ত্রিক সাধনার ক্ষেত্র”। মন্দিরের পিছনের দিকে অবস্থিত মহাস্মশান, যা তান্ত্রিকদের সাধনাক্ষেত্র। এখানেই অসংখ্য সাধক তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন মাতার চরণে। এর মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ সাধক বামাক্ষ্যাপা, যিনি ‘মায়ের পাগল’ নামে খ্যাত। তাঁর আশ্রম এবং সমাধিস্থল আজও ভক্তদের অন্যতম আকর্ষণ।
বামাক্ষ্যাপার অলৌকিক কাহিনিগুলো স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। কেউ বলেন, মা তাঁকে নিজের হাতে ভাত খাইয়েছিলেন; কেউ বলেন, মায়ের ইচ্ছাতেই তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। তাঁর সমাধিস্থলে গিয়ে আজও এক অনির্বচনীয় শান্তি ও শক্তির স্পর্শ অনুভূত হয়।
তীর্থের আশেপাশে
তারাপীঠে ভ্রমণের আরেকটি আকর্ষণ হলো আশেপাশের দর্শনীয় স্থানগুলি। দ্বারকানাথ ঠাকুরের অতিথিশালা, বামাক্ষ্যাপা আশ্রম, মহাস্মশান ঘাট, এবং স্থানীয় বাজারের ধর্মীয় সামগ্রী বিক্রির দোকানগুলো ঘুরে দেখলে বোঝা যায় এই তীর্থের ঐতিহ্য কত গভীর। সন্ধ্যাবেলায় আরতির ঘণ্টাধ্বনি, ধূপের গন্ধ, আর ভক্তদের গানের সুর মিশে সৃষ্টি করে এক অবর্ণনীয় আবেশ।
ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
তারাপীঠে ভ্রমণ মানে শুধু একটি ধর্মীয় স্থান দেখা নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করা। এখানে আসলে মনে হয়— দুঃখ, ব্যথা, ক্লান্তি সব যেন মায়ের চরণে মিলিয়ে যায়। মা যেন নিজের অদৃশ্য কোলে তুলে নেন প্রতিটি ভক্তকে।
ভ্রমণের শেষে ফিরে যাওয়ার পথে মনে হচ্ছিল— এই স্থান এক রহস্যময় শক্তিক্ষেত্র, যেখানে মানুষ ভক্তি, শক্তি, তন্ত্র ও মুক্তির অনুভব একসঙ্গে পায়।
সমাপ্তি
তারাপীঠের মাটি, গন্ধ, শব্দ— সবকিছুতেই মিশে আছে “মা তারা”-র অলৌকিক উপস্থিতি। তাই আজও লক্ষ লক্ষ মানুষ বারবার ফিরে আসে এখানে, নতুন আশায়, নতুন বিশ্বাসে।
জয় তারা মায়!












Leave a Reply