বাংলার বীরভূম জেলার অন্তরে, শান্তিনিকেতন থেকে অতি দূরে নয়, অবস্থিত এক বিস্ময়কর তীর্থক্ষেত্র—বক্রেশ্বর।

বাংলার বীরভূম জেলার অন্তরে, শান্তিনিকেতন থেকে অতি দূরে নয়, অবস্থিত এক বিস্ময়কর তীর্থক্ষেত্র—বক্রেশ্বর। এই স্থানটি একই সঙ্গে ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। ভগবান শিবের এক বিখ্যাত শক্তিপীঠ এবং গরম জলের উৎসের জন্য বিখ্যাত এই অঞ্চল, বহু যুগ ধরে ভক্ত, সাধক ও পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে।


🌋 স্থানপরিচয় ও অবস্থান

বক্রেশ্বর অবস্থিত বীরভূম জেলার ডুবরাজপুর থানার অন্তর্গত, সিউড়ি শহর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরে। কলকাতা থেকে প্রায় ২৪০ কিলোমিটার দূরে এই স্থানটি ট্রেন, বাস কিংবা ব্যক্তিগত গাড়িতে সহজেই পৌঁছানো যায়। শান্তিনিকেতন থেকে প্রায় এক ঘণ্টার পথ বক্রেশ্বরের দিকে এগোলেই দেখা মেলে এক অনন্য প্রাকৃতিক বিস্ময়—গরম জলের উৎস বা হট স্প্রিংস


🕉️ বক্রেশ্বর মন্দির ও পুরাণকথা

হিন্দু পুরাণ অনুসারে, দেবী সতীর ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে বক্রেশ্বর অন্যতম। কথিত আছে, এখানে সতীর ভগ (যোনি) অংশ পতিত হয়েছিল। এই স্থানে দেবী পূজিত হন বকেশ্বরী দেবী নামে, আর ভগবান শিবের রূপ হলেন বক্রেশ্বর—অর্থাৎ যিনি বেঁকে বসে আছেন।

মন্দিরের শিবলিঙ্গটিকে “বক্রেশ্বর শিব” বলা হয়। ভগবান শিব এখানে এক অসীম শান্তির মূর্তি, যাঁর উপস্থিতি সমগ্র অঞ্চলে এক আধ্যাত্মিক আবহ তৈরি করে রেখেছে। প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে ভক্তদের ভিড় দেখা যায়, বিশেষ করে শিবরাত্রি ও মকর সংক্রান্তি-তে এখানে অগণিত তীর্থযাত্রী আসেন।


💧 গরম জলের উৎস – প্রকৃতির বিস্ময়

বক্রেশ্বরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো গরম জলের উৎসসমূহ। এখানে প্রায় দশটিরও বেশি প্রাকৃতিক হট স্প্রিং রয়েছে, যার প্রতিটিরই তাপমাত্রা ও নাম আলাদা। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কয়েকটি হলো—

  1. অগ্নিকুন্ড
  2. সুর্যকুন্ড
  3. বায়ুকুন্ড
  4. বৈষ্ণবকুন্ড
  5. গৌরীকুন্ড
  6. অমৃতকুন্ড
  7. শঙ্ককুন্ড

এই উৎসগুলির জলের তাপমাত্রা গড়ে ৬০ থেকে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়। ঠান্ডা শীতের সকালে বা ভোরবেলায় এই উষ্ণ জলে ডুব দিলে শরীর ও মনে এক অনির্বচনীয় প্রশান্তি অনুভূত হয়।


🧪 বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

ভূতাত্ত্বিকদের মতে, এই গরম জলের উৎসগুলি আসলে ভূগর্ভস্থ আগ্নেয় শিলার তাপে উত্তপ্ত ভূগর্ভস্থ জলের নিঃসরণ। যখন ভূগর্ভে গরম ম্যাগমা শিলার সংস্পর্শে জল আসে, তখন তা তীব্রভাবে উষ্ণ হয়ে উপরে উঠে আসে, এবং তৈরি হয় এই হট স্প্রিংস।

এ জলে সালফার, সিলিকা, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম প্রভৃতি খনিজ উপাদান প্রচুর পরিমাণে থাকে। এর ফলে এই জলে স্নান করলে ত্বকের রোগ, বাত, সাইনাস ও স্নায়ুর সমস্যা দূর হয় বলে স্থানীয় ও ভ্রমণকারীদের বিশ্বাস। তাই বহু মানুষ চিকিৎসার আশায়ও এখানে আসেন।


🌼 তীর্থস্নান ও ধর্মীয় বিশ্বাস

হিন্দু ধর্মে “তীর্থস্নান”-এর বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। বক্রেশ্বরে গরম জলে স্নান করে বক্রেশ্বর শিব ও বকেশ্বরী দেবীর দর্শন করলে সব পাপ মোচন হয় বলে বিশ্বাস করা হয়।
বিশেষত মকর সংক্রান্তির দিন এখানে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী একত্রিত হন। গরম জলের ধোঁয়াময় কুণ্ডের পাশে ভক্তদের ঢল নেমে আসে—স্নান, ধ্যান, পূজা আর ভক্তির এক মহামিলন ঘটে সেদিন।


🌳 প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশ

বক্রেশ্বরের চারপাশে রয়েছে মনোরম লালমাটির প্রান্তর, তাল-খেজুর গাছের সারি ও সবুজ পাহাড়ি ঢিবি। সকালবেলায় গরম জলের ধোঁয়া আর সূর্যের আলো মিলেমিশে এক স্বপ্নময় দৃশ্য তৈরি করে। নদীর পাড়ে বসে দূরে দেখা যায় মন্দিরের চূড়া—এক পবিত্র শান্তি যেন এই ভূমিকে ঘিরে রেখেছে।


🎉 উৎসব ও মেলা

  1. মকর সংক্রান্তি মেলা – জানুয়ারি মাসে এই মেলা বক্রেশ্বরের প্রাণ। সপ্তাহব্যাপী চলে ধর্মীয় অনুষ্ঠান, হাট, নাট্য ও লোকসংগীতের আসর।
  2. মহাশিবরাত্রি – সারা রাত ধরে ভক্তরা শিবলিঙ্গে জল ঢেলে জপ করেন “ওম নমঃ শিবায়”।
  3. দুর্গাপূজা ও চৈত্র সংক্রান্তি – স্থানীয় মানুষদের আয়োজনে মন্দির চত্বর জেগে ওঠে উৎসবের রঙে।

🧘 ভক্তি ও শান্তির মিলন

বক্রেশ্বর কেবলমাত্র একটি তীর্থক্ষেত্র নয়—এটি মন ও শরীরের এক চিকিৎসালয়ও বটে। এখানে এসে কেউ ভগবানের আরাধনা করে, কেউ প্রকৃতির অলৌকিক শক্তিতে ধ্যানমগ্ন হয়, আবার কেউ শুধু উষ্ণ জলে স্নান করে প্রশান্তির পরশ খোঁজে।

এক ভক্তের মুখে শোনা যায়—

“এখানকার গরম জল যেন শিবের আশীর্বাদ—দেহের মলিনতা যেমন দূর করে, তেমনি মনেরও পরিশুদ্ধি ঘটায়।”


🚩 নিকটবর্তী দর্শনীয় স্থান

  • শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রভবন জাদুঘর (প্রায় ৫০ কিমি দূরে)
  • লাবপুরে সুলতানপুর মন্দির
  • দুবরাজপুরের ‘চন্দ্রদোপ’ পাহাড়
  • সিউড়ি রাজবাড়ি ও স্থানীয় হাটবাজার

🌺 সমাপ্তি

বক্রেশ্বর এমন এক স্থান যেখানে দেবতা ও প্রকৃতি হাত ধরে মানুষের কাছে শান্তি ও আরোগ্যের বার্তা নিয়ে আসে। এই গরম জলের উৎস শুধু ভূতাত্ত্বিক বিস্ময় নয়, এটি ভক্তি, সংস্কৃতি ও চিকিৎসার এক অনন্য সমন্বয়।

যে কেউ একবার বক্রেশ্বর এলে উপলব্ধি করবে—
প্রকৃতির উষ্ণ স্পর্শে যেমন শরীর উজ্জীবিত হয়, তেমনি দেবীর করুণায় আত্মাও পবিত্র হয়ে ওঠে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *