ভিক্ষে নয়, নাচ দেখিয়ে দান সংগ্রহ! বালুরঘাটে তরুণ নৃত্যশিল্পীদের নজির।

দক্ষিন দিনাজপুর, বালুরঘাট, নিজস্ব সংবাদদাতা :- বালুরঘাটের ব্যস্ত সন্ধ্যার রাস্তায় হঠাৎই ভিড় জমে যায়। ঢাক–ঢোল বা ঝাঁ চকচকে আলো নয়, একটি ছোট স্পিকার আর রাস্তার ধুলো মেখে নেচে চলেছেন একদল তরুণ–তরুণী। সামনে রাখা একটি বাক্স—যেখানে পথ চলতি মানুষজন খুশি মনে ফেলে দিচ্ছেন টাকা। সেই অর্থই পৌঁছে যাচ্ছে দুস্থ, ভবঘুরে ও অনাথ শিশুদের কাছে। বড় মাপের কনসার্ট করার সামর্থ্য নেই বলে রাস্তাতেই ‘স্ট্রিট ডান্স’ করে অর্থ সংগ্রহের এই অভিনব উপায় বের করেছেন বালুরঘাটের তরুণ নৃত্যশিল্পী শেখর বাসফোর।

আত্রেয়ী কলোনির বাসিন্দা শেখরের বড় হওয়া দারিদ্র্যের মধ্যে। হরিজন সম্প্রদায়ের পরিবার, চেহারা নিয়ে কটূক্তি—সব কিছুর সঙ্গেই লড়াই করে নাচকে বেছে নিয়েছেন তিনি। গত ১৫ বছর ধরে যুক্ত ওয়েস্টার্ন ডান্সে, অংশ নিয়েছেন একাধিক রিয়েলিটি শোতেও। এমনকি এক বাংলা ছবিতেও নেচেছেন। তাঁর অভিযোগ, ‘’ভারতনাট্যম বা বিভিন্ন নৃত্যকলাকে সম্মান জানালেও মফস্বল শহরে এখনও ওয়েস্টার্ন ডান্সকে অনেকেই বাঁকা চোখে দেখেন।’ তাই নাচকে সম্মানিত করার পাশাপাশি সমাজসেবার উদ্দেশ্য নিয়ে এমন রাস্তার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন তিনি।

কয়েকদিন আগেই থানা মোড় এলাকায় শেখরের নাচের দল রাস্তায় নেমে নাচলে জড়ো হয় ভিড়। দর্শকদের অনেকে নাচ দেখে এগিয়ে এসে টাকা দেন দানবাক্সে। সেই অর্থ দিয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে থাকা ভবঘুরেদের কম্বল বিলি করা হয়েছে। পাশাপাশি রঘুনাথপুরের একটি অনাথ আশ্রমে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেন তাঁরা। শেখরের লক্ষ্য গঙ্গারামপুর, বুনিয়াদপুর, হিলি সহ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে এই উদ্যোগ ছড়িয়ে দেওয়া এবং পথপশুদের খাবারের ব্যবস্থাও করা। তাঁর সঙ্গে এখন যুক্ত দশজন তরুণ নৃত্যশিল্পী। সমাজসেবী অরিত্র সাহাও উপস্থিত ছিলেন, তাঁকেও দেখা গিয়েছে দানবাক্স হাতে ঘুরে বেড়াতে।

স্ট্রিট ডান্সে উপস্থিত ছিলেন বালুরঘাটের ডিএসপি হেডকোয়ার্টার বিক্রম প্রসাদ। তিনি বলেন, ‘আমি সাহিত্য পড়েছি, নাচের প্রতি গভীর আগ্রহ আছে। বিভিন্ন সিনেমায় ও বিদেশে স্ট্রিট ডান্স দেখেছি। কিন্তু শহরের রাস্তায় এমন উদ্যোগ দেখে ভাল লেগেছে। তার উপর এর পেছনে দুস্থদের পাশে থাকার ইচ্ছা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে।’

পথ চলতি এক দর্শক, স্কুলশিক্ষিকা প্রতিমা দত্ত বললেন, ‘আমরা সাধারণত দেখি রাস্তার ধারে ভিক্ষা চলে। কিন্তু এখানে তরুণেরা নাচ দেখিয়ে উপার্জন করছে এবং তা দুঃস্থদের জন্য ব্যয় করছে—এটা সত্যিই ইতিবাচক দৃষ্টান্ত।’

আরেক দর্শক, অটোচালক কল্যাণ সরকার জানান, ‘আমি কাজের ফাঁকে দাঁড়িয়ে নাচ দেখছিলাম। ওদের প্রাণশক্তি দেখে ভাল লাগল। দুটো নোট দানবাক্সে দিলাম। আমার মতো মানুষের দেওয়া সামান্য টাকাও যদি কারও কাজে লাগে, তাতেই আনন্দ।’

নিজের স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে শেখর বলেন, ‘বড় কনসার্ট করার ক্ষমতা আমার নেই। অনেক লড়াই করে নাচ শিখেছি। তাই জেলায় স্ট্রিট ডান্স কালচার গড়ে তুলতে চাই, যেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ দুস্থদের কাজে লাগবে। ডিএসপি স্যারও পাশে থাকেন, উৎসাহ দেন। এটাই সবচেয়ে বড় প্রেরণা।’’

রাস্তায় নাচ, মানুষের অংশগ্রহণ, আর তার মধ্যেই সমাজসেবার বার্তা—বালুরঘাটে তাই স্ট্রিট ডান্স এখন শুধু বিনোদন নয়। যেন এক মানবিক আন্দোলনের মুখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *