পার্থ ঘোষ ছিলেন একজন খ্যাতনামা ভারতীয় বাঙালি আবৃত্তিকার তথা বাচিক শিল্পী। বাচিকশিল্পের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন তিনি। আজ কিংবদন্তি এই বাচিক শিল্পীর জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলে অবধরিত ভাবে চলে তার স্ত্রী গৌরী ঘোষের নাম। করান তিনি ও তার স্ত্রী গৌরী ঘোষ বাংলা আবৃত্তি জগতে ছিলেন অন্যতম জুটি। এই দম্পত্তি বাঙালিকে অনেক উপভোগ্য আবৃত্তি-সন্ধ্যা উপহার দিয়েছেন। গৌরী দেবী স্বামী পার্থ ঘোষের সঙ্গে মিলে বহু শ্রুতিনাটক উপস্থাপনা করেছেন। তাঁদের যৌথ ভাবে উপস্থাপিত ‘কর্ণকুন্তি সংবাদ’ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। পার্থ ঘোষ এবং গৌরী ঘোষের ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ এখনও বাঙালির মজ্জায় মজ্জায়৷ বাংলা কবিতা আবৃত্তিতে এক অন্য ধারা এনেছিলেন পার্থ ঘোষ। রবীন্দ্র কবিতা পাঠে তার কণ্ঠ ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আবৃত্তিশিল্পী হিসাবে সমাদৃত হয়েছেন দেশে বিদেশে সর্বত্র।
পার্থ ঘোষের জন্ম ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর বৃটিশ ভারতের কলকাতায়। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই বাংলা কবিতা আবৃত্তি তার প্রধান আগ্রহের বিষয় হয়ে যায়।
১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে উপস্থাপক-ঘোষক হিসাবে যোগদানের পর ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের পয়লা জানুয়ারি তিনি স্থায়ী কর্মী হিসাবে নিযুক্ত হন। নিয়মিত অন্যান্য অনুষ্ঠানের পাশাপাশি তিনি শিশু ও কিশোরদের জন্য “গল্পদাদুর আসর” পরিচালনা করতেন। দীর্ঘ সময় তিনি ছিলেন শিশু ও কিশোরদের ‘গল্পদাদু’। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি আকাশবাণীরই উপস্থাপিকা-ঘোষক আবৃত্তিকার গৌরী মজুমদারকে বিবাহ করেন।১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি আকাশবাণীর “বিবিধ ভারতী” বিভাগে যোগদান করেন এবং ২০০০ খ্রিস্টাব্দে অবসরের আগে পর্যন্ত ওই বিভাগে কর্মরত ছিলেন। প্রায় তিন দশকের বেশী সময় ধরে কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত আকাশবাণীর অনেক অনুষ্ঠানে বাংলার শ্রোতারা শুনেছেন সুস্নাত ব্যক্তির কণ্ঠে সুরম্য উপস্থাপনা।
১৯৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দ হতেই তিনি ও তার স্ত্রী গৌরী ঘোষ আবৃত্তিচর্চার সঙ্গে যুক্ত হন। জনপ্রিয় জুটি দীর্ঘ কয়েকদশক ধরে দেশে বিদেশে সুনামের সঙ্গে আবৃত্তি পরিবেশন করেছেন। তারা আবৃত্তি ও শ্রুতিনাটককে এক অনন্য মাত্রায় পৌছে দেন। তাঁদের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথেরই ‘দেবতার গ্রাস’, ‘বিদায়’ বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিল। প্রবাদপ্রতীম এই আবৃত্তি দম্পতি দশকের পর দশক ধরে বাংলার শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। এ রাজ্যের পাশাপাশি তাঁদের আবৃত্তি সমাদর কুড়িয়েছে বাংলাদেশেও।
পার্থ ঘোষের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ বসন্ত’ খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। স্ত্রী গৌরীর সঙ্গে তার শ্রুতিনাটক ‘প্রেম’, ‘স্বর্গ থেকে নীল পাখি’, ‘জীবনবৃত্ত’ বাংলার শ্রোতাদের হৃদয়ে অম্লান। বাংলা কবিতা নিয়ে তাদের একাধিক সিডি-ক্যাসেট রয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যও ছিলেন।
রবীন্দ্র গবেষণায় তার আগ্রহ ছিল। সম্পাদনা করেছেন কবিতা বিষয়ক গ্রন্থ। এছাড়া পার্থ ঘোষের শখ ছিল পুতুল সংগ্রহের। দেশ বিদেশের নানান পুতুল ছিল তার সংগ্রহে।
তার অনবদ্য আবৃত্তি বাংলার শ্রোতাদের হৃদয়ে যে অনুভূতি জাগ্রত করে তারই স্বীকৃতি স্বরূপ পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে “বঙ্গভূষণ” সম্মাননা প্রদান করে।
আগেই (২০২১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ আগস্ট) না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন তাঁর সহধর্মীনি কিংবদন্তী আবৃত্তিকার গৌরী ঘোষ। ভেঙে গিয়েছিল বিখ্যাত পার্থ ঘোষ-গৌরী ঘোষের জুটি।
স্ত্রী প্রয়াত হলে প্রায়শই অসুস্থতার মধ্যেই ছিলেন পার্থ ঘোষ।গলায় অস্ত্রোপচার হয়েছিল। এরপর অকস্মাৎ ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে’র ভোরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তি এই বাচিক শিল্পী পার্থ ঘোষ।
।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবপেজ।।