উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি লেখক যার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভ্রমণকাহিনী, যা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ধারা। তিনি তাঁর ভ্রমণকাহিনী মণি মহেশ এর জন্য ১৯৭১ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন—
উমাপ্রসাদ ১৯০২ সালের ১২ই অক্টোবর বিজয়াদশমী দিনে জন্মগ্রহণ করেন; কলকাতার ভবানীপুর এলাকার রাসা রোডের বিখ্যাত মুখোপাধ্যায় পরিবারে। তাঁর পিতা ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ বেঙ্গল টাইগার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং মাতা ছিলেন যোগমায়া দেবী। আশুতোষ ও যোগমায়ার সাত সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বিজয়াদশমীতে জন্ম নেওয়ায় তাঁর ডাক নাম ছিল বিজু। মা যোগমায়া দেবী ছিলেন একজন অত্যন্ত সুন্দরী এবং করুণাময় প্রগতিশীল মহিলা, যার প্রভাব তার সমস্ত সন্তানের উপর পড়বে নিশ্চিত। শৈশবে উমাপ্রসাদকে খুব সুন্দর দেখালেও তার শারীরিক স্বাস্থ্য ভালো ছিল না; মাত্র ৫ বছর বয়সে তিনি টাইফয়েডে আক্রান্ত হন। শৈশব থেকেই, লেখক ছিলেন একজন উজ্জ্বল, অন্তর্মুখী, প্রাণী প্রেমিক এবং সহানুভূতিশীল ব্যক্তি। তাঁর শৈশবের একটি বিবরণ পাওয়া যাবে তাঁর “আমার শৈশব” প্রবন্ধে। হাটখড়ির পর বাড়ির বিশাল গ্রন্থাগারে উমাপ্রসাদের প্রথম পাঠ শুরু হয়। তাঁর প্রথম শিক্ষক ছিলেন প্রিয়নাথ বসু এবং মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
শিক্ষা—-
সাত বছর বয়সে ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনে তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৯১৯ সালে, উমাপ্রসাদ প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯২১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এই পরীক্ষায় বাংলা রচনায় শ্রেষ্ঠত্বের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র রৌপ্য পদক ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বৃত্তি ও পুরস্কার, ভাষা ও গণিতে ভালো নম্বরের জন্য ডাফ স্কলারশিপ, ইংরেজি ও গণিতে সারদাপ্রসাদ পুরস্কার এবং পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার জন্য স্টিফেন বিন পদক। এরপর ওই কলেজ থেকে ১৯২৩ সালে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাস করে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তারপর ১৯২৫ সালে, তিনি “প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি” বিষয়ে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। এরপর তিনি আইন অধ্যয়ন শুরু করেন এবং ১৯২৮ সালে বিএল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে সপ্তম স্থান অধিকার করেন।
পেশা–
প্রথম জীবনে সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি দীর্ঘ বিশ বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইন কলেজে অধ্যাপনা করেন। অত্যন্ত স্ব-গম্ভীর কিন্তু হাস্যরসে পরিপূর্ণ, লেখক আজীবন একজন বিবেকবান এবং অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন। তার বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্র এবং সাংবাদিক অরুণ বাগচি। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি আইনজীবী হিসেবেও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। আলিপুর কোর্ট, বিড়লা কোম্পানির আইন উপদেষ্টা, বেঙ্গল লাইব্রেরির ফিনান্স বিভাগের কাউন্সিল মেম্বার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার চেয়ারম্যান, লিকুইডেটর এবং ট্যাবুলেটর। কর্মক্ষেত্রে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সংস্পর্শে আসেন।
পরিব্রাজক—
উমাপ্রসাদ ছিলেন একজন অক্লান্ত পরিব্রাজক। তার যৌবনের শুরুতে, তিনি ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে মাতৃদেবীর সাথে তার প্রথম হিমালয় দর্শনে যান। অতঃপর এই অকৃতজ্ঞ পথিক দীর্ঘক্ষণ হিমালয়ের পথে হেঁটেছেন – গায়ের ফতুয়া আর লুঙ্গি পরে, কাঁধে ঝোলা। পরে, গহন জঙ্গলে, রুক্ষ মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াতেন এবং নৌকায় যাত্রী হয়ে সমুদ্রে ভ্রমণ করতেন। চিত্রকলা ও সিনেমাটোগ্রাফিতে তার গভীর জ্ঞান ছিল। অসংখ্য স্থিরচিত্র ছাড়াও তিনি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কৈলাস-মানস সরোবর যাত্রার একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে তোলা তাঁর ছবির অ্যালবাম ‘আলোকচিত্রে হিমালয়’ সেই সময়ের হিমালয়ের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের একটি অমূল্য দলিল। শুধু হিমালয় নয়, সৌরাষ্ট্রের গিরনার বা এলাহাবাদের কুম্ভ মেলার মতো বিষয়গুলিও তাঁর ছবির প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সাহিত্যকর্ম—-
উমাপ্রসাদ সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। পরিব্রাজক হিসাবে উমাপ্রসাদের নিজের দেখা নিজের বিষয়কে নিয়ে সহজ ভাষায় যে সমস্ত বই লিখেছেন সেগুলি বিশিষ্ট সাহিত্য হয়ে উঠেছে। হিমালয় ও ভারতের গিরিপথ ও গিরিশৃঙ্গ বিষয়ে লেখা বইয়ের সংখ্যা বেশি।
তার অন্যান্য আরো গ্রন্থ গুলি হল-
‘শেরপাদের দেশে’, ‘কুয়ারী গিরিপথে’, ‘পালামৌর জঙ্গলে’, ‘ভ্রমণ অমনিবাস’ (৫ খণ্ড), ‘শরৎচন্দ্র প্রসঙ্গ’, ‘শ্যামাপ্রসাদের ডায়েরি ও মৃত্যু প্রসঙ্গ’, ‘স্যার আশুতোষের দিনলিপি’ (অনুবাদ), ‘জলযাত্রা’ , ‘কাবেরী কাহিনী’, ‘বৈষ্ণোদেবী ও অন্যান্য কাহিনী’, ‘আরবসাগরের তীরে’, ‘দুই দিগন্ত’,
‘তপোভূমি মায়াবতী’, ‘কৈলাস ও মানস সরোবর’, ‘মণিমহেশ’, ‘দুধওয়া’, ‘পঞ্চকেদার’ ‘ক্যালাইডেস্কোপ’।
পুরস্কার—
তিনি তার সাহিত্যকর্মের জন্য অনেক সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৭১ সালে, তিনি তার ভ্রমণ গ্রন্থ “মণিমেশ” এর জন্য ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।