সূচনা—-
ঘুরতে কে না ভালোবাসে। বিশেষ করে বাঙালিরা সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে ভ্রমনের নেশায়। কেউ পাহাড়, কেউ সমুদ্র আবার কেউ প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান ভালোবাসে ভ্রমণ করতে। প্রকৃতি কত কিছুই না আমাদের জন্য সাজিয়ে রেখেছে। কতটুকুই বা আমরা দেখেছি। এ বিশাল পৃথিবীতে আমরা অনেক কিছুই দেখিনি। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় আজ গোটা পৃথিবীটা হাতের মুঠোয়় এলেও প্রকৃতিকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করা এ এক আলাদা রোমাঞ্চ, আলাদা অনুভূতি যার রেষ হৃদয়ের মনিকোঠায় থেকে যায় চিরকাল।। তাইতো আজও মানুষ বেরিয়ে পড়়ে প্রকৃতির কে গায়ে মেখে রোমাঞ্চিত হওয়ার নেশায়। আসুন ঘুরে আসি ভারতের ই একটি দর্শণীয় স্থান উত্তরাখন্ডের হর কি দুন ভ্যালি ট্রেক ।Valley of Gods, হর কি দুন ভ্যালি ট্রেক যা ভারতের সবচেয়ে পুরোনো ট্রেকিং গুলির মধ্যে অন্যতম।
আপনি যদি এমন কিছুর সাক্ষী হতে চান যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মানকেও ছাড়িয়ে যায়, তবে হার কি দুন উপত্যকায় একটি দুঃসাহসিক অভিযান আপনার জন্য উপযুক্ত হবে।
প্রাকৃতিক অবস্থান—-
হর কি দুন বা হর কি দুন হল ভারতের উত্তরাখণ্ডের গাড়ওয়াল হিমালয়ের একটি দোলনা-আকৃতির ঝুলন্ত উপত্যকা। অঞ্চলটি সবুজ বুগিয়াল (উচ্চ উচ্চতার তৃণভূমি) দিয়ে ঘেরা। এটি তুষার আচ্ছাদিত চূড়া এবং আলপাইন গাছপালা দ্বারা বেষ্টিত। এটি বোরাসু পাসের মাধ্যমে বাসপা ভ্যালির সাথে সংযুক্ত। এই উপত্যকাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় 3566 মিটার (১১৭০০ ফু) উপরে এবং অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত তুষারে ঢাকা থাকে। হর কি দুন হল একটি দোলনা আকৃতির উপত্যকা যা তুষারাবৃত চূড়া এবং আলপাইন গাছপালা দ্বারা বেষ্টিত, হার-কি-দুন হল, হ্যান্ডস ডাউন, একটি সবচেয়ে সুন্দর ট্রেকিং গন্তব্য যা উত্তরাখণ্ডের অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রদর্শন করে। হর কি দুন উপত্যকা গাড়ওয়াল হিমালয়ের দূরবর্তী অঞ্চলে অস্পৃশ্য উপত্যকার দর্শনীয় দৃশ্য দেখায়। এটি ভারতের সবচেয়ে সুন্দর স্থানগুলির মধ্যে একটি যা অসংখ্য ট্রেকিং ভ্রমণের প্রস্তাব দেয়।
হর কি দুনের ইতিহাস—-
ঐতিহাসিকভাবে, এটি বিশ্বাস করা হয় যে রাজা যুধিষ্ঠিরকে এখানকার একটি চূড়া থেকে একটি কুকুর সহ স্বর্গের আবাসে পাঠানো হয়েছিল। এটাও বিশ্বাস করা হয় যে হাজার হাজার বছর আগে যারা এখানে বাস করত তারা কৌরবদের পাশাপাশি পাণ্ডবদের শাসনাধীন ছিল। “হর কি দুনের শাব্দিক অর্থ ঈশ্বরের উপত্যকা। বলা হয়ে থাকে পঞ্চপান্ডবের কোন একজন এই উপত্যকা দিয়েই স্বর্গারোহিনী পর্বত অতিক্রম করে স্বর্গে যান। স্বর্গরোহিনী পিকই নাকি স্বর্গের শেষ দ্বার এবং সেই থেকেই এই পাহাড়ের এই নাম। স্বর্গারোহিনী পর্বত এই ভ্যালির পাশেই অবস্থিত। মজার বিষয় হচ্ছে এখানকার আঞ্চলিকেরা মনে করেন এই পর্বত মাউন্ট এভারেস্ট থেকেও উঁচু।
ঈশ্বরের উপত্যকা—-
“ভারতের সবচেয়ে পুরোনো ট্রেকিং গুলির মধ্যে একটি হলো হর কি দুন ভ্যালি ট্রেক যা Valley of Gods নামেও পরিচিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৫৬৬ মিটার (১১৬০০ ফুট) উচ্চতাবিশিষ্ট এই ট্রেককিং রুটটি উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশি রাজ্যের গারোয়াল হিমালয়ের পশ্চিম পারে অবস্থিত। শীত এবং গ্রীষ্ম উভয় সিজনেই যাওয়া যায় এই রুটে। হর কি দুন পিকের পাশাপাশি স্বর্গরোহিনী পর্বতমালা সর্বদা আপনার সাথেই থাকবে মোটামুটি সমস্ত ট্রেকটি জুড়েই। স্বর্গের দ্বার শুধু নয়, স্বর্গেরই এক অংশ যেন হর-কি-দুন (Har ki Dun Trek), এজন্যই এর আরেক নাম ঈশ্বরের উপত্যকা।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য—
সমস্ত পথটি জুড়ে রয়েছে পাইন জঙ্গলের নিস্তব্ধতা এবং বিস্তৃত উপত্যকার মন্ত্রমুগ্ধতা। শীতকালীন বরফাবৃত এলপাইন ম্যাডো, সঙ্গে মেঘ চিরে বেরিয়ে আসা সূর্যকিরণ এবং অন্যদিকে গ্রীস্মকালীন সবুজ উপত্যকা ও সঙ্গে দূরের স্বর্গরোহিনীর মাথার সাদা বরফ জীবনের এক নতুন মানে শেখাবে আপনাকে। তামসা নদীর পাশে ৫ কোটি তারার নিচে ক্যাম্প করে রাত্রি কাটানো আপনার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে রয়ে যাবে। এখান থেকে স্বর্গরোহিনী ১,২,৩, বন্দরপুচ, ব্ল্যাকপিক, রুইনসারা পিক সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। এই ট্রেকটির রুটে কিছু ২০০০ বছর পুরোন গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাবেন আপনি, পরিচিত হবেন সেই সকল প্রাচীন জনগোষ্ঠীর জীবনধারার সাথে।”
হর কি দুনের আশেপাশে প্রধান আকর্ষণ গুলি কি কি তা জেনে নেবো সংক্ষেপে–
গ্রাম পর্যটন—–
যখন আপনি এই মনোমুগ্ধকর পর্যটন গন্তব্যে যাওয়ার পথে আছেন উত্তরাখণ্ড, আপনি স্থানীয় গ্রামবাসীদের দ্বারা অধ্যুষিত বিভিন্ন গ্রাম জুড়ে আসতে পেতে. এই সমস্ত কিছুই আপনাকে কেবল একটি ন্যূনতম জীবনযাত্রার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় না বরং আপনাকে তাদের রীতিনীতি এবং ঐতিহ্যগুলি জানতে সাহায্য করে, আপনার আত্মার উপর একটি অদম্য ছাপ রেখে যায়।
পাখি দেখা এবং ফটোগ্রাফি—-
এখানে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বৈচিত্র্য দেখে আপনি আপনার ক্যামেরার লেন্সের মাধ্যমে প্রকৃতির আনন্দের সেই মুহূর্তগুলিকে ক্যাপচার করতে বাধা দেবেন না। এবং যখন আপনি স্ন্যাপ নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, আপনি সর্বদা একটি ভাল জায়গা খুঁজে পেতে পারেন এবং কেবল বসে বসে পাখিদের কুচকুচে দেখতে পারেন।
ট্রেকিং—
বেশিরভাগ পর্যটক এই অঞ্চলের ক্ষমাহীন টপোগ্রাফিতে ট্রেকিং করে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পাওয়ার জন্য হর কি দুন পরিদর্শন করেন। এবং শেষ পর্যন্ত, এটি অবশ্যই ঝুঁকির মূল্য, কারণ আপনি এখানে তুষার-ঢাকা পাহাড়, বন এবং ক্যাসকেডিং জলপ্রপাতের সাক্ষী হতে পারেন।
ক্যাম্পিং—
এখন, এটি প্রকৃতির কোলে আপনার সবচেয়ে আশ্চর্যজনক জীবনের অভিজ্ঞতাগুলির মধ্যে একটি। খাস্তা রাতের আকাশের নীচে আপনার বন্ধুদের সাথে তাঁবু স্থাপনের অনুভূতি সারাজীবনের অবিস্মরণীয় স্মৃতি তৈরি করে।
যাওয়ার সেরা সময়—–
সাধারণত সারা বছরই এখানে লোকজনের যাতায়াত দেখা যায়। যাইহোক, এখানে ভ্রমণের সেরা সময় হবে শরৎ এবং শীত ঋতু। গ্রীষ্মকাল (এপ্রিল থেকে জুন) এবং বর্ষার পরেই (সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর) হর কি দুন ট্রেকের জন্য সেরা সময়। এটি একটি Moderate Trek হিসেবে বিবেচিত হয়। ভালো ভাবে সময় নিয়ে ঘুরতে চাইলে ১০ দিন হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন।
যাওয়ার উপায়—
হর কি দুনে যেতে গেলে আপনাকে দেরাদুন যেতে হবে প্রথমেই। সেখান থেকে মোটামুটি ১০ ঘন্টার জার্নি করে সানক্রি গ্রাম যা ১৯৫০ মিটার উচুতে অবস্থিত। এটিই হর কি দুন ট্রেকের বেস ক্যাম্প। কেদারকান্থা, বালি পাস, বরাসু পাস ট্রেক করতে গেলেও এই সানক্রি গ্রাম থেকেই যেতে হবে আপনাকে। সানক্রি থেকে অনেক ভাবেই আপনি যেতে পারেন নিজের সুবিধা মতন। এখানে যে রুটটি নিয়ে আলোচনা করা হলো সেটি বেশ প্রচলিত একটি রুট। আপনি গাইডের সাথে কথা বলে নিজেদের মতন রুট বানিয়ে নিতে পারেন।
সানক্রি থেকে আবার গাড়ি ঠিক করে আপনাকে ১২ কিলোমিটার দূরে ২১০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত তালুকা পৌঁছতে হবে, ছোট গাড়ি চলে এখন। এখান থেকে পায়ে হাঁটা রাস্তা শুরু। সেদিনের উদ্যেশ্য ১০ কিলোমিটার দূরের ২৫০০ মিটার উচ্চতার পুয়ানি গড়াত। তালুকা থেকে সময় লাগবে মোটামুটি ৬ ঘন্টা। এখানে আপনি টেন্ট পিচ করে থাকতে পারেন। পরের দিন পুয়ানি গড়াত থেকে ২৯৫০ মিটার উচ্চতার কালকাটতিয়াধার। পরের দিনই পৌঁছে যাবেন ৩৫৬৬ মিটার উচ্চতার হর কি দুন। রাত কাটান হর কি দুন ক্যাম্প সাইটে। এখান থেকে স্বর্গরোহিনীকে সত্যিই মনে হবে যেন পাহাড়টি মাটি ফুঁরে স্বর্গের দিকে উঠে গেছে।”
“হর কি দুন ভ্যালির শেষটি দুটি পৃথক রাস্তা সৃষ্টি করে, একদিকে মনিন্দ্র তাল ও বরাসু পাস, অন্য দিকে যৌনদর গ্লেসিয়ার এবং এই দুইয়ের মাঝে কর্মনাসা নামক ছোট্ট একটি জলধারা। স্বর্গ দেখতে না পেলেও এই জায়গাটিই আপনার কাছে স্বর্গ হয়ে থেকে যাবে। হাতে সময় থাকলে মনিন্দ্র তাল এবং যৌনদর গ্লেসিয়ার দুইই ঘুরে আসতে পারেন, তাতে অবশ্য সমস্ত ট্রেকটি দুদিন বেড়ে যাবে। ফিরতি পথে ওসলা গ্রামে একটি রাত কাটান। এখানেই রয়েছে ৫০০০ বছর পুরোন একটি কাঠের ঘর, এই জায়গাটিকে স্থানীয় লোকেরা দুর্যোধনের মন্দির হিসেবে পূজিত করেন। পরের দিন পৌঁছে যান সানক্রি, যেখান থেকে শুরু করেছিলেন এই দীর্ঘ যাত্রা। সেখান থেকে পুনরায় দেরাদুন। যাওয়া আসা মিলে ৫০ কিলোমিটার হাঁটা। হাঁটতে হবে মোট চারদিন।”
আকাশ পথে—
জলি গ্রান্ট বিমানবন্দর ওরফে দেরাদুন বিমানবন্দর (DED) নিকটতম বিমানবন্দর। এখানে পৌঁছানোর জন্য দিল্লি এবং চণ্ডীগড় হয়ে সংযোগকারী ফ্লাইট নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বিমানবন্দর থেকে, আপনার থাকার জন্য প্রথমে আপনাকে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের কিছু মাধ্যম পেতে হবে এবং সেখান থেকে সানকারি গ্রামে যেতে হবে, যেখানে অ্যাডভেঞ্চার শুরু হয়।
তাই আপনি যদি এমন কিছুর সাক্ষী হতে চান যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মানকেও ছাড়িয়ে যায়, তবে হার কি দুন উপত্যকায় একটি দুঃসাহসিক অভিযান আপনার জন্য।
।।তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট।।