মহারাজা নন্দকুমার: ভারতের ইতিহাসে প্রথম বিচারিক হত্যার শিকার শহীদ এক দেশপ্রেমিক।

ভারতের স্বাধীনতা পূর্ব ইতিহাসে মহারাজা নন্দকুমারের নাম এক করুণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তিনি শুধু একজন প্রশাসক বা রাজস্ব সংগ্রাহক ছিলেন না, বরং অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক সাহসী ব্যক্তিত্ব, যিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ইতিহাসে ভারতের প্রথম বিচারিক হত্যার শিকার হিসেবে চিহ্নিত হন।

🧬 জন্ম ও কর্মজীবনের শুরু

নন্দকুমারের জন্ম ১৭০৫ সালে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার ভদ্রপুর গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। বাংলার নবাবের অধীনে কাজ করার মাধ্যমে তিনি প্রশাসনিক জীবন শুরু করেন। পলাশীর যুদ্ধের পর তাঁকে রবার্ট ক্লাইভের কাছে সুপারিশ করা হয় রাজস্ব সংগ্রাহক নিযুক্ত করার জন্য।
১৭৬৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁকে বর্ধমান, নদীয়া ও হুগলি জেলার দেওয়ান (কর সংগ্রাহক) হিসেবে নিযুক্ত করে। সেই বছরেই মুঘল সম্রাট শাহ আলম দ্বিতীয় তাঁকে “মহারাজা” উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ধর্মীয়ভাবে বৈষ্ণব দর্শনের অনুরাগী ছিলেন এবং রাধামোহন ঠাকুরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।

⚖️ হেস্টিংস বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্রের সূচনা

১৭৭৩ সালে যখন ওয়ারেন হেস্টিংস আবার বাংলার গভর্নর-জেনারেল পদে বহাল হন, তখন মহারাজা নন্দকুমার তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের গুরুতর অভিযোগ আনেন। তিনি দাবি করেন, হেস্টিংস এক মিলিয়ন টাকারও বেশি ঘুষ নিয়েছেন এবং তাঁর কাছে তা প্রমাণ করার মতো নথিও রয়েছে। এই অভিযোগ হেস্টিংসের রাজনৈতিক অবস্থানকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়।
কিন্তু এরপরই পাল্টা চক্রান্ত শুরু হয়। হেস্টিংস তাঁর স্কুল বন্ধু ও তৎকালীন কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি স্যার এলিজা ইম্পির সহায়তায় মহারাজার বিরুদ্ধে নথি জালিয়াতির মামলা দায়ের করেন।

⚖️ বিচার না ষড়যন্ত্র?

১৭৭৫ সালের ৫ আগস্ট, কলকাতার বিদ্যাসাগর সেতুর নিকটবর্তী স্থানে মহারাজা নন্দকুমারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এটি ছিল ভারতের ইতিহাসে প্রথম মৃত্যুদণ্ড যা আইনত ফাঁসির মাধ্যমে কার্যকর হয়।
তবে অনেক ইতিহাসবিদ একে বিচারিক হত্যা বলেই অভিহিত করেছেন। কারণ:

মামলার বিচারপতি ইম্পি ছিলেন হেস্টিংসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

যে আইন (Fraudulent Document Act, 1728) অনুযায়ী তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, সেটি মূলত শুধুমাত্র ব্রিটেনে প্রযোজ্য ছিল, ভারতের উপনিবেশে নয়।

নন্দকুমারের বিচার ছিল একতরফা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, এবং প্রমাণসাপেক্ষে দুর্বল।

এই ঘটনার জেরে হেস্টিংস ও ইম্পি দুজনই পরবর্তীতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অভিশংসিত হন। এই ষড়যন্ত্রের জন্য এডমন্ড বার্ক ও থমাস ম্যাকলে তাদের কড়া ভাষায় অভিযুক্ত করেছিলেন।

🕊️ উত্তরাধিকার

মহারাজা নন্দকুমার শুধুমাত্র প্রশাসক নন, ছিলেন এক নীতিবান দেশপ্রেমিক, যিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন নিজ জীবন বাজি রেখে। তাঁর আত্মত্যাগ ভারতের ঔপনিবেশিক ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত—যেখানে আইনকে হাতিয়ার করে নিপীড়নের বিচারিক মুখোশ তৈরি করা হয়েছিল।
আজ তাঁর মৃত্যুবরণের দিনে শ্রদ্ধা জানাই মহারাজা নন্দকুমারকে—যিনি সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন, এবং হয়ে উঠেছিলেন এক শহীদ, এক ইতিহাসের নাম।

📚 তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *