৫ আগস্ট ১৯৩১—এই দিনেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন গীতা দে, যিনি শুধু একজন অভিনেত্রী নন, ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্র, থিয়েটার এবং লোকনাট্যের এক বহুমুখী প্রতিভা, এক জীবন্ত ইতিহাস। মাত্র ছয় বছর বয়সে মঞ্চে পা রাখা এই শিশুশিল্পী পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিলেন এক শক্তিশালী চরিত্রাভিনেত্রী, যিনি বাংলার নাট্য ও চলচ্চিত্রজগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন নিজের অসাধারণ অভিনয়শৈলীতে।
🎭 শুরুটা শিশু শিল্পী হিসেবে
গীতা দে’র অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ দেখতে পেয়ে তাঁর বাবা অনাদিবন্ধু মিত্র তাঁকে গায়িকা রাধারানী দেবীর কাছে নাচ, গান ও অভিনয়ের তালিমের ব্যবস্থা করেন। সেই তালিমের ফলস্বরূপ, মাত্র ছয় বছর বয়সে ১৯৩৭ সালে ধীরেন গাঙ্গুলি পরিচালিত ‘আহুতি’ ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন তিনি। এরপর একে একে অভিনয় করেন ‘দম্পতি’ এবং ‘নন্দিতা’ ছবিতে।
🎬 চলচ্চিত্র ও মঞ্চজগতের সেতুবন্ধনে
১৯৪৪ সালে তিনি পূর্ণাঙ্গ অভিনেত্রী হিসেবে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপরের ছয় দশকের বেশি সময়ে তিনি দুই শতাধিক চলচ্চিত্র এবং দুই হাজারেরও বেশি মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন। তুলসী লাহিড়ী, শম্ভু মিত্র, তুলসী চক্রবর্তী, জ্ঞানেশ মুখার্জি, কালী সরকার, কানু ব্যানার্জি, দিলীপ রায়ের মতো থিয়েটার ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয় তার।
🎞️ সত্যজিৎ-ঋত্বিক যুগে গীতা দে
তিনি অভিনয় করেছেন সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটক-এর মতো কিংবদন্তি পরিচালকদের ছবিতে। মেঘে ঢাকা তারা, সুবর্ণরেখা, কোমল গান্ধার, তিন কন্যা, কত আজনারে—প্রতিটি ছবিতেই তিনি চরিত্রে নিজেকে এমনভাবে মিশিয়ে দিতেন যে দর্শক সহজে ভুলতে পারতেন না।
১৯৫৬ সালে কালী ব্যানার্জির মাধ্যমে ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনি ঋত্বিককে নিয়ে বলেন, “ক্যামেরার ব্যবহার এবং শট গ্রহণের ব্যাপারে এত বড় মাপের পরিচালক আমি আর দেখিনি।”
🎤 রেডিও ও মঞ্চ নাটকে অবিস্মরণীয় অবদান
১৯৫৪ সাল থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিও’র সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন গীতা দে। রেডিও নাটকে তার কণ্ঠ অভিনয় শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে। তাঁর শেষ মঞ্চনাটক ছিল ‘বাদশাহী চল’, যা ১৯৯৬ সালে রঙ্গনা মঞ্চে পরিচালনা করেন গণেশ মুখোপাধ্যায়।
🎭 বহুমাত্রিক অভিনয়শৈলী
গীতা দে নেতিবাচক, ইতিবাচক, কৌতুক—সব ধরনের চরিত্রে নিজেকে দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। তার অভিনয় নজর কেড়েছিল এমনকি বিশ্ববিখ্যাত অভিনেতা লরেন্স অলিভিয়ার-এরও।
🎥 উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রসমূহ
তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের তালিকা বিশাল—সাত পাকে বাঁধা, নৌকাডুবি, মাল্যদান, নিশিপদ্ম, দুই ভাই, মৌচাক, ইন্দ্রাণী, সুবর্ণরেখা, কোমল গান্ধার, তিন কন্যা, বর্ণচোরা, সাথী হারা, মেঘে ঢাকা তারা, মহাপৃথিবী, পরিণীতা (২০০৫), টলি লাইটস সহ আরও অনেক। প্রতিটি ছবিতে তাঁর চরিত্রে অভিব্যক্তি ছিল সাবলীল, স্বতঃস্ফূর্ত ও গভীর।
🏆 পুরস্কার ও স্বীকৃতি
গীতা দে বাংলা চলচ্চিত্রে আজীবন অবদানের জন্য ১৯৮৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তারকা পদক লাভ করেন, যা তাঁকে প্রদান করেন তৎকালীন গভর্নর সৈয়দ নুরুল হাসান। তিনি রাষ্ট্রপতি পুরস্কারেও ভূষিত হন।
⚰️ বিদায়
১৭ জানুয়ারি ২০১১ সালে, ৭৯ বছর বয়সে কলকাতায় গীতা দে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু তাঁর কাজ, তাঁর প্রতিভা, তাঁর অভিনয়ের সেই স্পর্শ এখনও রয়ে গেছে বাংলা সিনেমা ও থিয়েটারের হৃদয়ে।
আজ তাঁর জন্মদিনে, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করি বাংলার এই অমর অভিনেত্রীকে, যিনি শুধু এক জীবন নয়—এক অধ্যায় হয়ে আছেন আমাদের সংস্কৃতির ইতিহাসে।
📚 তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট
Leave a Reply