দার্জিলিং – নামটা উচ্চারণ করলেই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে কুয়াশা-ঢাকা পাহাড়, সবুজ চা-বাগান আর দূরে হিমালয়ের শ্বেতশুভ্র চূড়া। কিন্তু দুর্গাপুজোর সময় এই পাহাড়ি শহরের রূপ আরও যেন বেড়ে যায়। কলকাতার ভিড়ভাট্টা থেকে বেরিয়ে ঠান্ডা, শান্ত অথচ উৎসবমুখর দার্জিলিং শহরে কাটানো কয়েকটা দিন আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ভ্রমণ।
🛤️ যাত্রার শুরু – ট্রেনে পাহাড়ের ডাক
শারদীয়ার এক ভোরে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে পদাতিক এক্সপ্রেসে চেপে বসলাম। সঙ্গে কিছু বন্ধু, ব্যাগপত্তর, আর মন ভর্তি উত্তেজনা। ট্রেন যখন মালদা, কিশনগঞ্জ পেরিয়ে শিলিগুড়ির দিকে ছুটে চলল, জানালার বাইরে ধানখেতের সবুজ আর নদীর জলের ঝিলিক মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দিচ্ছিল।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামতেই ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা যেন জানান দিল – পাহাড় আর দূরে নয়।
🚙 উপরে ওঠার পথ – প্রকৃতির রঙিন ছবি
শিলিগুড়ি থেকে জিপে উঠে শুরু হল পাহাড়ি পথের যাত্রা। টিস্তা নদী আমাদের সঙ্গী হয়ে চলল কিছুদূর। নদীর নীল-সবুজ জলে সূর্যের আলো পড়তেই ঝিলমিল করতে লাগল। রাস্তার বাঁকে বাঁকে ছোট ছোট দোকান, যেখানে গরম চা আর সিঙ্গারা পাওয়া যায়। এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে আমরা চা খেলাম – পাহাড়ি দুধ-চায়ের স্বাদ একেবারেই আলাদা।
উঠতে উঠতে যখন সেনচাল বনপথ পেরোলাম, তখন কুয়াশা আমাদের ঘিরে ধরল। চারদিকে সবুজ, পাইন গাছের সারি, দূরে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ি গ্রামের ছোট ছোট কুঁড়েঘর। দার্জিলিং পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে গেল।
🏨 দার্জিলিং পৌঁছে – হোটেল, কুয়াশা আর প্রথম সন্ধ্যা
হোটেলে পৌঁছে জানালা খুলতেই ঠান্ডা বাতাস মুখে এসে লাগল। দূরে দেখা গেল কাঞ্চনজঙ্ঘার ম্লান ছায়া। ব্যাগ খুলে গরম জামা পরে বেরিয়ে পড়লাম মল রোডের দিকে।
মল রোডে তখন পুজোর ভিড়। দোকানগুলোতে নতুন জামাকাপড়, পাহাড়ি হস্তশিল্প, শাল, মোমো আর থুকপার গন্ধে পুরো এলাকা মাতোয়ারা। ঢাকের বদলে এখানে বাজছে পাহাড়ি বাঁশির সুর, তবুও উৎসবের আবহ কম নয়।
🏯 দার্জিলিং-এর পুজো – ছোট শহরের বড় উচ্ছ্বাস
দার্জিলিং-এ দুর্গাপুজো কলকাতার মতো জমকালো না হলেও একেবারে হৃদয়ের কাছাকাছি। এখানে প্রধানত স্থানীয় বাঙালি সম্প্রদায় মিলে পুজোর আয়োজন করে।
- দার্জিলিং বাংলোবাসী পুজো: এখানে প্যান্ডেল ছোট হলেও সুন্দর। দেবীর মূর্তিতে থাকে এক বিশেষ পাহাড়ি ছোঁয়া।
- লোয়ার টাউন ও টাকভার পুজো: এই পুজোগুলোও বেশ জনপ্রিয়। মন্ত্রপাঠ, ধুনুচি নাচ আর সিঁদুর খেলায় অংশ নেন স্থানীয় মানুষজন।
- পুজোর সময় পাহাড়ি লোকেরা যেভাবে আনন্দ ভাগ করে নেন, তা দেখে মনে হয় শহরের পুজো যতই বড় হোক, গ্রামের পুজোর সেই আন্তরিকতাই আলাদা।
🚂 টয় ট্রেনের অভিজ্ঞতা – যেন শৈশবের গল্পের বইয়ে
দার্জিলিং এসে টয় ট্রেন না চড়লে ভ্রমণই অসম্পূর্ণ। আমরা বুক করেছিলাম দার্জিলিং-ঘুম টয় ট্রেনের যাত্রা।
সকালে স্টিম ইঞ্জিনের হুইসেল শুনেই যেন সময় থেমে গেল। ছোট্ট কামরায় বসে পাহাড়ি রেললাইনের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে চলতে লাগল ট্রেন।
বাতাসে ঠান্ডার ছোঁয়া, পাশে চা-বাগানের সবুজ ঢাল, দূরে দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা – মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দি করলেও মন চাইল না তা ছেড়ে আসতে।
🌄 টাইগার হিলের সূর্যোদয় – জীবনের সেরা সকাল
পুজোর অষ্টমীর দিন ভোর চারটেয় উঠে টাইগার হিলের পথে রওনা দিলাম। ঠান্ডায় হাত-পা জমে যাচ্ছিল, কিন্তু ভিড় জমেছিল অনেক। সবাই অপেক্ষা করছিল এক ঝলক সূর্যোদয় দেখার জন্য।
হিমালয়ের সাদা চূড়ায় প্রথম সোনালি আলো পড়তেই যে দৃশ্য তৈরি হল, তা ভাষায় বোঝানো যায় না। কাঞ্চনজঙ্ঘা তখন লালচে-সোনালি রঙে ঝলমল করছে। মনে হল দেবী যেন নিজেই আমাদের আশীর্বাদ করতে এসেছেন।
☕ চা-বাগানের ট্যুর – প্রকৃতির রঙে রঙিন সকাল
দার্জিলিং-এর চা-বাগান ঘুরে দেখা ছিল আমাদের পরের দিনের পরিকল্পনা। হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেটে গিয়েছিলাম। সেখানে চা-পাতা তোলার দৃশ্য দেখলাম, গাইড আমাদের বোঝাল চা প্রক্রিয়াকরণ কীভাবে হয়। শেষে এক কাপ ফ্রেশ দার্জিলিং টি খাওয়ার সুযোগ পেলাম – হালকা সুবাস, মিষ্টি স্বাদ, একেবারে স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা।
🍜 পাহাড়ি খাবারের স্বাদ
দার্জিলিং-এর মোমো, থুকপা, টাংরা সবই ট্রাই করলাম। মল রোডের ছোট ছোট ক্যাফেতে গরম কফি বা চকোলেট ব্রাউনি খাওয়ার আনন্দ অন্যরকম। পুজোর দিনে দুপুরে খাসা বাঙালি ভোজও হয়েছিল – খিচুড়ি, লুচি, বেগুনি, চাটনি, পায়েশ – মনে হয়েছিল যেন বাড়ির মতোই।
🎶 সন্ধ্যার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
পুজোর সময় দার্জিলিং-এর ক্লাবগুলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। স্থানীয় বাচ্চাদের নাচ, পাহাড়ি গান, বাউল সংগীত – সবই একসঙ্গে শোনার সুযোগ পেলাম। ছোট শহরের পুজো হলেও এর প্রাণশক্তি এতটাই বেশি যে মন ভরে গেল।
🛍️ স্মৃতির ঝুলি – কেনাকাটা ও ছবি
শেষ দিনে নিউ মার্কেট ও চৌরাস্তা ঘুরে কেনাকাটা করলাম। পাহাড়ি হস্তশিল্প, উলের সোয়েটার, ছোট্ট টিবেটিয়ান মূর্তি আর রঙিন ঝুল – সবই নিয়ে এলাম।
ক্যামেরায় ধরা পড়ল কাঞ্চনজঙ্ঘার নানা রূপ, টয় ট্রেনের ধোঁয়া, পুজোর মণ্ডপ আর আমাদের হাসিমুখ।
❤️ উপসংহার – এক অন্যরকম পুজো
দার্জিলিং-এর দুর্গাপুজো আমার কাছে ছিল এক শান্ত অথচ প্রাণবন্ত অভিজ্ঞতা। কলকাতার ভিড়, শব্দ আর অতিরিক্ত আড়ম্বর থেকে বেরিয়ে এখানে প্রকৃতির কোলে কয়েকটা দিন কাটিয়ে মনে হয়েছিল যেন নতুন করে জীবন শুরু হল।
কাঞ্চনজঙ্ঘার সূর্যোদয়, টয় ট্রেনের হুইসেল, পাহাড়ি মানুষের আন্তরিকতা আর পুজোর উচ্ছ্বাস – সবকিছু মিলিয়ে এই ভ্রমণ ছিল এক স্বপ্নের মতো।
দার্জিলিং শুধু একটি পাহাড়ি শহর নয়, এটি এক অনুভূতি। দুর্গাপুজোর সময় সেই অনুভূতি আরও গভীর হয়। যদি কখনও শান্ত অথচ প্রাণবন্ত দুর্গাপুজোর অভিজ্ঞতা পেতে চান, তবে দার্জিলিং অবশ্যই আপনার তালিকায় থাকা উচিত।
Leave a Reply