যে ভূমি একসময় সারা পৃথিবীর জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থক্ষেত্র ছিল, যেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষু থেকে শুরু করে দূর দেশের পণ্ডিতরা এসেছিলেন বিদ্যা অর্জনের উদ্দেশ্যে — সেই ভূমির নাম নালন্দা (Nalanda)। বিহারের এই ঐতিহাসিক স্থান শুধু ইট-পাথরের ধ্বংসাবশেষ নয়; এটি প্রাচীন ভারতের জ্ঞান, সংস্কৃতি ও সভ্যতার জীবন্ত প্রতীক। নালন্দা ভ্রমণ যেন অতীতের এক আলোকিত সভ্যতার দ্বারে ফিরে যাওয়া।
🏛️ নালন্দার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
নালন্দা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৫ম শতাব্দীতে গুপ্ত সম্রাট কুমারগুপ্ত প্রথম-এর শাসনকালে। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় (Residential University), যেখানে একসঙ্গে ১০,০০০ ছাত্র ও ২,০০০ শিক্ষক বসবাস ও পাঠদান করতেন।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বৌদ্ধ ধর্ম, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বের উচ্চতর শিক্ষা দেওয়া হতো। চীন, কোরিয়া, তিব্বত, জাপান থেকে বহু ছাত্র নালন্দায় পড়তে আসতেন। বিখ্যাত চীনা ভিক্ষু হিউয়েন সাং (Xuanzang) ও ই-চিং (Yijing) এখানকার ছাত্র ছিলেন এবং তাঁদের লেখা থেকেই আমরা নালন্দার উজ্জ্বল ইতিহাস জানতে পারি।
🌺 আমার নালন্দা ভ্রমণ — সময়ের স্রোতে ফিরে যাওয়া
নালন্দায় পৌঁছাতেই প্রথমেই চোখে পড়ে বিশাল ইটের ধ্বংসাবশেষ, যার প্রতিটি ইটে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের হাজারো গল্প। রৌদ্রের আলোয় লালচে ইটের গাঁথুনি যেন আজও অতীতের শিক্ষার দীপ্তি ছড়ায়। ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, আমি যেন এক প্রাচীন ছাত্র, যে বৌদ্ধ দর্শন পড়তে এসেছে এই বিদ্যাপীঠে।
🕍 নালন্দা মহাবিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ
আজও এখানে দেখা যায়
- স্তূপ (Stupa),
- প্রার্থনাগৃহ (Chaitya),
- শিক্ষাকক্ষ (Lecture Halls),
- এবং আবাসিক কক্ষ (Monk’s Cells) —
যেগুলো প্রমাণ করে যে, এই স্থান একসময় ছিল উচ্চশিক্ষার মহাকেন্দ্র।
বিশেষভাবে নজর কাড়ে মন্দির নং ৩ — বিশালাকার একটি স্তূপ, যার চারপাশে বুদ্ধমূর্তিগুলি খোদাই করা। স্তূপের ওপরে উঠলে পুরো নালন্দা ধ্বংসাবশেষ চোখে ধরা পড়ে, আর মনে হয়, যেন ইতিহাস নিজেই দাঁড়িয়ে আছে সামনে।
📖 হিউয়েন সাং স্মারক মিউজিয়াম
নালন্দা ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ হলো হিউয়েন সাং স্মারক জাদুঘর। এখানে সংরক্ষিত আছে চীনা ভিক্ষু হিউয়েন সাং-এর জীবনী, তাঁর ব্যবহৃত দ্রব্য, প্রাচীন দলিল ও পাণ্ডুলিপি। তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে নালন্দার শ্রেষ্ঠত্বের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে, যা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের প্রাচীনতম জ্ঞানকেন্দ্র হিসেবে প্রমাণ করে।
🪶 নালন্দার ধ্বংস – এক করুণ ইতিহাস
১২শ শতাব্দীতে তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খিলজি এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ধ্বংস করে দেন। বলা হয়, নালন্দার বিশাল গ্রন্থাগারে প্রায় ৯০ লক্ষ পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি ছিল, যা আগুনে পুড়তে পুড়তে তিন মাস ধরে জ্বলেছিল। সেই আগুনের ধোঁয়ায় যেন নিভে গিয়েছিল প্রাচীন ভারতের জ্ঞানালো।
কিন্তু ধ্বংসের পরও নালন্দার আত্মা আজও জীবিত — প্রতিটি ইটে আজও গর্বের প্রতিধ্বনি।
🪷 আধুনিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় — জ্ঞানের নবজাগরণ
২০১৪ সালে ভারত সরকার নতুন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় (Nalanda University) পুনর্গঠন করে, যা আধুনিক উচ্চশিক্ষার এক আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। আজ সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্রছাত্রী পড়তে আসে, বৌদ্ধ দর্শন, ইতিহাস, পরিবেশবিদ্যা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো বিষয়ে গবেষণা করে।
এটি যেন প্রমাণ করে — নালন্দার শিক্ষা কখনও মরে না, কেবল নতুন রূপে ফিরে আসে।
🚆 যাত্রাপথ ও দর্শনীয় স্থান
নালন্দা পৌঁছানোর সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায় হল পাটনা (প্রায় ৮৫ কিমি) বা রাজগির (১২ কিমি) থেকে। গয়া থেকেও সরাসরি গাড়িতে পৌঁছানো যায়।
নালন্দার আশেপাশে ভ্রমণযোগ্য আরও কিছু স্থান —
- রাজগিরের গ্রিডাকূট পাহাড়,
- বোধগয়া,
- হিউয়েন সাং মেমোরিয়াল,
- নতুন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস,
- সিলাও মিষ্টি (খাজা) — যা খেতে ভুললে ভ্রমণ অসম্পূর্ণ।
🌄 ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
সন্ধ্যাবেলায় নালন্দা ধ্বংসাবশেষে সূর্যাস্তের আলো পড়লে মনে হয়, অতীত যেন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। বাতাসে ভেসে আসে দূর অতীতের ছাত্রদের পাঠরত কণ্ঠস্বর। চারপাশের নীরবতা, প্রাচীন স্থাপত্য আর ইতিহাসের গভীরতা মিলে গড়ে তোলে এক মায়াময় অনুভূতি — যেন আমি নিজেই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছি।
🕊️ উপসংহার
নালন্দা কেবল একটি স্থান নয়; এটি ভারতের গৌরব, জ্ঞানের প্রতীক ও সভ্যতার আলোকস্তম্ভ। এখানে এসে বোঝা যায়, শিক্ষা কেবল বই নয়, এটি এক অন্তর্জাগরণ, যা মানবতার ভিত্তি।
যদি কখনও তুমি অতীতের আলোয় স্নান করতে চাও, যদি জানতে চাও ভারতের প্রকৃত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, তবে নালন্দা ভ্রমণ তোমাকে হতাশ করবে না। কারণ এখানে ইতিহাস নিঃশব্দে বলে —
“জ্ঞানই সর্বোচ্চ পুজা, আর নালন্দা তার মন্দির।” 📜✨












Leave a Reply