দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যের কাসারগোড় জেলায় অবস্থিত বেকাল ফোর্ট (Bekal Fort), এমন এক ঐতিহাসিক নিদর্শন যা সমুদ্র, ইতিহাস, স্থাপত্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য সংমিশ্রণ।
আরব সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এই বিশাল দুর্গ যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নীরবে বলে চলেছে অতীতের যুদ্ধ, রাজনীতি, আর রাজকীয় মহিমার কাহিনি।
🏰 ইতিহাসের পাতায় বেকাল ফোর্ট
বেকাল ফোর্টের ইতিহাস প্রায় ১৭ শতকের শুরুতে পৌঁছে যায়।
প্রথমে এটি নির্মাণ করেছিলেন শিবাপ্পা নায়েকা (Shivappa Nayaka), যিনি ইক্কেরি সাম্রাজ্যের শক্তিশালী রাজা ছিলেন।
পরে এটি ব্যবহৃত হয়েছে হায়দার আলী ও টিপু সুলতান-এর আমলে প্রতিরক্ষা দুর্গ হিসেবে।
১৮ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশরা এটি নিজেদের দখলে নেয় এবং তখন থেকেই এটি দক্ষিণ ভারতের উপকূলীয় প্রতিরক্ষা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
দুর্গটি মূলত যুদ্ধের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল — রাজাদের প্রতিরক্ষার জন্য নয়। এই কারণেই দুর্গের ভিতরে কোনো রাজপ্রাসাদ বা বিলাসবহুল স্থাপত্য নেই। বরং রয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, অস্ত্র রাখার কক্ষ, গোপন সুড়ঙ্গ ও সৈন্যদের থাকার স্থান।
🌊 আরব সাগরের তীরে স্থাপত্যের মহিমা
বেকাল ফোর্টের সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর দিক হল এর অবস্থান।
এটি ৪০ একর জুড়ে বিস্তৃত এবং আরব সাগরের তীরে প্রায় ১৬০ ফুট উঁচু এক পাথুরে ক্লিফের ওপর দাঁড়িয়ে।
দুর্গের উপরে দাঁড়ালে দেখা যায় চারদিকে নীল সাগর, দূরে নারকেল গাছের সারি, আর ঢেউয়ের গর্জন যেন অতীতের গল্প শুনিয়ে যায়।
স্থাপত্যের দিক থেকে এটি কাসারগোড় অঞ্চলের বৃহত্তম দুর্গ, যার প্রাচীরগুলো বিশাল গ্রানাইট পাথরে গড়া।
দুর্গের উপর থেকে একদিকে দেখা যায় বেকাল বিচ, অন্যদিকে পল্লিকেরে বিচ— দুটোই যেন ইতিহাসের প্রহরী হয়ে রয়েছে দুর্গের পাশে।
🕰️ রহস্য ও কিংবদন্তি
বেকাল ফোর্টকে ঘিরে রয়েছে বহু কিংবদন্তি।
জনশ্রুতি আছে, প্রাচীনকালে এই দুর্গের নীচে গোপন সুড়ঙ্গ ছিল, যা সমুদ্রের নিচ দিয়ে বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
আবার কেউ কেউ বলেন, দুর্গের চারপাশে থাকা পুরনো পাথরের ভাস্কর্যগুলো কোনো এক হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার স্মারক।
দুর্গের প্রাচীরের ওপর থেকে সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতা যেন এক রহস্যময় কাব্য — লাল সূর্যের আলো যখন সাগরের জলে প্রতিফলিত হয়, তখন মনে হয়, সময় থেমে গেছে সেই অতীত যুগে।
📷 সিনেমার পর্দায় বেকাল ফোর্ট
বেকাল ফোর্ট শুধু ইতিহাস নয়, এটি ভারতের চলচ্চিত্রের এক অনন্য প্রতীকও।
বলিউডের বিখ্যাত সিনেমা “বম্বে” (1995)-এর গানে — “Tu Hi Re…” — যে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা যায়, তার শুটিং হয়েছিল এই দুর্গেই।
তারপর থেকেই বেকাল ফোর্ট দেশের ও বিদেশের পর্যটকদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণের স্থান হয়ে ওঠে।
🌿 প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেকাল
দুর্গের আশেপাশে রয়েছে বেকাল বিচ পার্ক, যেখানে সুশোভিত বাগান, পাথরের বেঞ্চ, আর সমুদ্রের দৃশ্য উপভোগ করার জন্য নিরিবিলি বসার স্থান তৈরি করা হয়েছে।
আরও একটু দূরে গেলে দেখা যায় চন্দ্রগিরি ফোর্ট, আর বেকাল হোলিডে রিসর্ট এলাকা — যেখানে পর্যটকদের জন্য নানা আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
এছাড়াও বেকালের কাছেই রয়েছে কাপিল বিচ, চন্দ্রগিরি নদী, এবং নিত্যানন্দ আশ্রম গুহা, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক পরিবেশে ভরপুর।
🛣️ যেভাবে পৌঁছানো যায়
📍 অবস্থান: কেরালার উত্তর প্রান্তে, কাসারগোড় জেলার সমুদ্রতীরে।
🚆 নিকটতম রেলস্টেশন: বেকাল ফোর্ট রেলওয়ে স্টেশন (Bekal Fort Railway Station)।
✈️ নিকটতম বিমানবন্দর: ম্যাঙ্গালুরু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (প্রায় ৭০ কিমি দূরে)।
🕓 ভ্রমণের সেরা সময়: নভেম্বর থেকে মার্চ — আবহাওয়া মনোরম, আকাশ নির্মল, আর সমুদ্র শান্ত।
🍛 কেরালার স্বাদে বেকালের অতিথি
ভ্রমণের সময় এখানকার মালাবার স্টাইল সি-ফুড, আপ্পাম ও ফিশ কারি, কারিমিন পোলিচাথু, আর ফিল্টার কফি না খেলে সফর অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
স্থানীয় বাজারে কেরালার মসলা, নারকেল তেল, কাঠের হস্তশিল্প, ও কাসারগোড়ের ঐতিহ্যবাহী সিল্ক “কাসাভু শাড়ি” পাওয়া যায়।
🌺 উপসংহার
বেকাল ফোর্ট কেবল একটি দুর্গ নয় — এটি সমুদ্রের বুকের ওপর লেখা এক ইতিহাসের কবিতা।
যেখানে পাথর আর ঢেউ মিলে বলে চলে অতীতের সাহস, যুদ্ধ, প্রেম ও সময়ের গল্প।
যে কেউ একবার এখানে এলে বুঝতে পারেন, ইতিহাস কখনও পুরনো হয় না —
বরং বেকালের ঢেউয়ের মতোই তা বারবার ফিরে আসে, নতুন আলোয়, নতুন রূপে। 🌊✨












Leave a Reply