আমাদের ভারতীয় সত্য সনাতন ধর্মে মূল্যবান সুন্দর মনুষ্য জীবনে “মানুষ, ভগবান ও ঈশ্বর” কথাগুলি মোটেও এক নয়। তাই, সরল ভাবে সাধারণ ভাবে মানুষ, ভগবান ও ঈশ্বর কি? ভারতমাতার পবিত্র ও পূণ্যভূমিতে ঘুরে ঘুরে একটু জানার চেষ্টা করা। ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ও আমাকে ভুলগুলি বলে দেবেন। কারণ, আমি কিছু শেখার চেষ্টা করছি মাত্র।
আমরা জানি, একজন *প্রকৃত মানুষ* হলেন তিনি, যার মধ্যে মানবিক গুণাবলি যেমন দয়া, ক্ষমা, ভালোবাসা, সহনশীলতা, এবং ইতিবাচকতা বিদ্যমান। যিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি সৎ ও নীতিবান। আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল। তার মধ্যে সততা, নৈতিকতা এবং নিজের কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে, এবং তিনি কখনোই অন্যদের প্রতারিত বা ক্ষতি করেন না। ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সবার মঙ্গল চিন্তা করেন। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টোটল বলেছেন “man is a social animal”. আর ধর্ম হলো একটি প্রক্রিয়া যা মানুষকে তার সর্বোচ্চ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে সাহায্য করে। ধর্ম মানুষকে পশুর মতো প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত করে এবং তাকে সম্পূর্ণ মানুষে পরিণত করে, এবং পরবর্তীতে দেবত্বে উন্নীত করে।
আর সংক্ষেপে, *ভগবান* হলেন, এমন এক সত্তা যার মধ্যেই ভগবানের ছটি গুন/ঐশ্বর্য (যেমন – ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য) পূর্ণরূপে বিদ্যমান। তাঁর মধ্যে এই ছয়টি গুণের পূর্ণ প্রকাশ দেখা যায়। সাধারণত সর্বোচ্চ দেবতাকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন ধর্মে এর প্রয়োগ ভিন্ন হতে পারে। যেমন সত্য সনাতন ধর্মে শ্রীকৃষ্ণকে স্বয়ং ভগবান হিসাবে বর্ণনা করা হয়।
আবার *ঈশ্বর* হলেন সেই সত্তা যিনি মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং শাসক, অথবা অন্যভাবে বললে, তিনি অস্তিত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সত্তা। প্রকৃত ঈশ্বরকে সংক্ষেপে “আদি শক্তি” বলা হয়, এছাড়াও, ঈশ্বরকে “পরমাত্মা”, “পরমেশ্বর”, “ইষ্টদেবতা”, বা “ঈশ্বর” হিসেবেও উল্লেখ করা হয়, যা বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও শাস্ত্রের উপর নির্ভর করে। অসীম এবং শাশ্বত বলে মনে করা হয়, যিনি নিজেকেই সৃষ্টি করেছেন। সত্য সনাতন ধর্মে, ‘ঈশ্বর’ শব্দের অর্থ পরমাত্মা।
আমরা যদি গভীরে যাই, *ভগবানঃ* ‘জন্মদাস্য যত’- যার থেকে সমস্ত প্রকাশিত হয়। ভাগবদ পুরাণ (১/১) ভগবান শব্দটি সংস্কৃত, এবং এর অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন ব্যাসদেবের পিতা পরাশর মুনি (১) সমগ্র ঐশ্বর্য (ধনসম্পদ) (২) সমগ্র বীর্য (৩) সমগ্র যশ (৪) সমগ্র শ্রী (সৌন্দর্য) (৫) সমগ্র জ্ঞান (৬) সমগ্র বৈরাগ্য। যিনি এই ষড়ৈশ্বর্য গুনযুক্ত তিনিই ভগবান পদবাচ্য। আবার *ভগবান- ভ- ভূমি, গ- গগন, ব- বায়ু, অ/আ- অগ্নি, ন- নীর। এই ভূমি, গগন, বায়ু, অগ্নি ও নীর- কে যিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তিনিই ভগবান।
আমরা যদি আর একটুও গভীরে যায়, *ঈশ্বর* শব্দের অর্থ হল সর্বশক্তিমান। *ঈশ্বর হল সয়ম্ভূ, অজ। যার কোন জন্ম নেই, মৃত্যু নেই।* যিনি সর্বত্র বিরাজমান, সকলের মুক্তিদাতা, সগুণে সাকার কিংবা নির্গুণে নিরাকার, প্রয়োজনে বহু রূপ ধারণ করতে পারেন, তিনিই হচ্ছেন ঈশ্বর, পরমেশ্বর, পরমাত্মা। ঈশ্বর এক, অবিভক্তে তিনি এক। বিভক্তে তিনি বহু। *ঈশ্বর নিজ আনন্দে এই বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন। তিনিই সৎ-চিৎ-আনন্দ বিগ্রহ। তিনিই অনাদি, তিনিই নিত্য, জ্ঞানময়, আনন্দময়।* তিনি হচ্ছেন অনাদি, সয়ম্ভূ, এবং সমস্ত কারণের মূল কারণ। ঈশ্বর বলতে বোঝায়, সর্বশ্রেষ্ঠ সত্তা, পরমাত্মা, প্রভু, জগৎস্রষ্টা, অধিপতি ইত্যাদি। ঈশ্বরকে ভগবান, পরমেশ্বর, ইষ্টদেবতা, বিশেষ আত্মা ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। ঈশ্বরকে বিশ্বজগতের সর্বোচ্চ স্রষ্টা বলা হয়। ভগবান হলেন ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান, ও বৈরাগ্যের অধীশ্বর। ঈশ্বর ও ভগবানের মধ্যে পার্থক্য হল – ঈশ্বর শব্দের অর্থ হল বিশ্ব জগতের সর্বোচ্চ স্রষ্টা। ভগবান হলেন ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান,ও বৈরাগ্যের অধীশ্বর। ঈশ্বরকে পরমেশ্বরও বলা হয়। ঈশ্বরকে পরমাত্মাও বলা হয়। ঈশ্বরকে ইষ্টদেবতাও বলা হয়। ঈশ্বরকে বিশেষ আত্মাও বলা হয়।
যেমন, আমরা বাস্তবে দেখি *অসৎ* লোকের ভাবনায় ঈশ্বর দৈত্য, দানব, রাক্ষস! সে তারা স্বীকার করুন আর নাই করুন। তাইতো তারা ঈশ্বরকে ভয় পায়। অসৎ না হলে ঈশ্বরকে ভয় পাবে কেন?
*লোভী এবং নির্বোধ* ব্যক্তির কাছে ঈশ্বর অলৌকিক এক শক্তি ! কাল্পনিক এই অসীম শক্তির সাথে তারা দেওয়া এবং নেওয়া নীতি (Give and take policy) এর হিসাব করে। কল্পিত ঈশ্বরকে তারা নানারকম (মানত করে) উপহার দিয়ে ঈশ্বরের সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করে।
*ধর্মব্যবসায়ীদের* কাছে ঈশ্বর হচ্ছে তাদের সম্পত্তি। তাই তারা খরিদ্দার ধরার তাগিদে দোকান খুলে বসে। এসব ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্ম ব্যবসা করে, এরা বিরাট সম্পদ, সম্পত্তি গড়ে তোলে।
*আবার সুযোগসন্ধানী সুবিধাবাদী ব্যক্তিদের কাছে (ছল, চতুর, প্রতারক, চোর, নিন্দুক, দুর্নীতিবাজ, চাটুকার) ঈশ্বর হচ্ছেন,পরিস্থিতির সুযোগ। কর্ম তাদের মনোমতো হলে ঈশ্বর আছেন। আর কর্ম তাদের মনোমতো নাহলে ধূর..! ওসব ঈশ্বর, ভগবান-টগবান বলে কিছু নেই।*
*নাস্তিকের* কাছে ঈশ্বরের কোন অস্তিত্ব না থাকলেও তারা ঈশ্বর নেই, ঈশ্বর নেই বলে চলে সদা সর্বদা। ঈশ্বর-বিশ্বাসীদের ক্রমাগত বাজে মন্তব্য করে সবচাইতে অমানবিক আচরণ করে। তারা ভুলে যায় বিশ্বাসীদের বিশ্বাসে আঘাত করা ঘৃণ্য মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। তাই, তারা নিজে নাস্তিক থাকুন, কোন অসুবিধা নেই। অন্যের মানসিকতাই আঘাত দেবেন না।
*আস্তিকের কাছে, আত্মাই ঈশ্বর। নিজের মাঝে যে শুভশক্তিটুকু আছে সেটাই ঈশ্বর। নিজের ভেতর থেকে যখন জানার আগ্রহ প্রবল হয়, সেই জ্ঞানতৃষা মেটানোর পথটুকুই ঈশ্বর। কর্মই ঈশ্বর, ঈশ্বর হচ্ছে জ্ঞান, ঈশ্বর যুক্তি, ঈশ্বরই মুক্তি। ঈশ্বর পেতে হলে নিজের ভেতরে অনুসন্ধান চালাতে হয়। শুভ ইচ্ছা নিয়ে নিজের ভেতরে খুঁজে বেড়ালেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। আত্মজিজ্ঞাসাই ঈশ্বর।*
*একইভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র
ষড়ৈশ্বর্য যুক্ত ছিলেন তাই তাঁদের কে আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বলে সম্বোধন করি।* ভারতীয় সত্য সনাতন ধর্মের মধ্যে যখন কোন মানুষকে ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য এই ছয়টি গুনের অধীশ্বর রূপে আরাধনা করা হয় তখন তাকে ভগবান বলা হয় বা আমরা বলে থাকি। যেমন আদি শঙ্করাচার্য, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য, ভগবানবুদ্ধ, স্বামী প্রণবানন্দ ইত্যাদি। যেমন, আমরা গুরু মহারাজকে জগৎগুরু ভগবান স্বামী প্রণবানন্দজী বলে সম্বোধন করি বা বলে থাকি। নিজ নিজ মতের অনুসরণকারীরা নিজেদের গুরুদের ভগবান বলে থাকেন। কিন্তু ঈশ্বর বলা যাবে না। কারণ ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বর জন্ম মৃত্যু রহিত। কারণ *ঈশ্বর হল সয়ম্ভূ, অজ। যার কোন জন্ম নেই, মৃত্যু নেই।* আরো অনেক মহামানব এই পবিত্র ভারতভূমিতে জন্মেছেন তাদেরকে ও আমরা অনেকেই ভগবান বলে থাকি। তাদের শ্রীচরণে ভুলুন্ঠিত প্রণাম নিবেদন করি।
*বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখছি, অনেক মানুষ অজ্ঞানতাবশত বা জ্ঞানবশত, সুবিধাবাদী, সুযোগ সন্ধানী লোক, কোন সাধু মহাত্মা বা কারো সঙ্গে ছবি তুলে, তাকে আমার ঈশ্বর বলে প্রচার করছেন। সুবিধা লাভের আশায় প্রচারের আশায়। লোভে পড়ে তার নিজের ব্যক্তিগত প্রচার ও লাভের আশায়। তারা আমাদের সত্য সনাতন ধর্মের বিরাট ক্ষতি করছেন। তারা ঈশ্বর কাকে বলে হয়তো জানেন না বা জেনেও না জানার ভান করছেন। তাই প্রকৃত সাধু-সন্ন্যাসী মানুষদের ও সনাতনীদের এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।*
আমাদের ভারতীয় সত্য সনাতন ধর্ম হল সেই বিজ্ঞান যেটা বহু বছর ধরে সাধু, সন্ন্যাসী, জ্ঞানী, মহাত্মাদের সঠিক মার্গ দর্শনে আমাদের দেশে ক্রমশ বেড়ে উঠেছে। তাই সত্য সনাতন ধর্ম হল একটা বিজ্ঞান সম্মত ধর্ম যার নাম সনাতন ধর্ম,শাশ্বত চিরন্তন ধর্ম। তাই, আমাদের ধর্মের কোন প্রবর্তক নেই। আমাদের সত্য সনাতন ধর্মে সামাজিক জীবনে ধর্মীয় প্রভাব অপরিসীম। তাই, সত্য সনাতন ধর্মে ঈশ্বরকে এক ও অদ্বিতীয় বলা হয়। কারণ, তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সর্বত্র বিরাজমান, সর্বজনীন, নিরাকার, এবং সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনিই পরম কারণ এবং সর্বোচ্চ সত্তা। পরিশেষে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে সবার জন্য শুভ মঙ্গলময় আশীর্বাদ প্রার্থনা করি।
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ ।
স্বামী আত্মভোলানন্দ *পরিব্রাজক*













Leave a Reply