আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের হৃদয়ে লুকিয়ে আছে ইতিহাস, সৌন্দর্য আর রহস্যে মোড়া এক বিস্ময়কর দ্বীপ — রস আইল্যান্ড।

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের হৃদয়ে লুকিয়ে আছে ইতিহাস, সৌন্দর্য আর রহস্যে মোড়া এক বিস্ময়কর দ্বীপ — রস আইল্যান্ড। বর্তমানে এর সরকারী নাম নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু দ্বীপ, কিন্তু এর ঐতিহাসিক নাম ‘রস আইল্যান্ড’ আজও মানুষের মুখে মুখে বেঁচে আছে।
একসময় এই দ্বীপ ছিল ব্রিটিশ শাসনের ‘রাজধানী’, আজ সেখানে শুধু ধ্বংসাবশেষ, নিস্তব্ধতা আর প্রকৃতির কবিতা।


🏰 রস আইল্যান্ডের পরিচয়

রস আইল্যান্ড আন্দামানের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ। ব্রিটিশ আমলে এটি ছিল অ্যান্ডামান পেনাল সেটেলমেন্টের প্রশাসনিক সদর দফতর, যেখানে থেকে সমগ্র দ্বীপপুঞ্জ পরিচালিত হত।
কিন্তু ১৯৪১ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে দ্বীপটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর প্রশাসন স্থানান্তরিত হয় পোর্ট ব্লেয়ারে। তারপর থেকে রস আইল্যান্ড ধীরে ধীরে প্রকৃতির অধিকারভুক্ত হয়ে যায় — গাছপালা, শ্যাওলা, আর নিঃশব্দ স্মৃতি তার নতুন বাসিন্দা হয়।


⚓ কিভাবে পৌঁছাবেন

পোর্ট ব্লেয়ারের রাজীব গান্ধী ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্স থেকে মাত্র ১০ মিনিটের নৌকা যাত্রায় পৌঁছে যাওয়া যায় রস আইল্যান্ডে। ছোট ফেরি বা স্পিডবোটে ভেসে যেতে যেতে দূর থেকে দেখা যায় নারকেল গাছের ছায়ায় ঢাকা এক পুরনো শহর — ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।


🌿 প্রকৃতির কোলে ইতিহাস

দ্বীপে পা রাখলেই মনে হবে আপনি যেন এক রহস্যময় চলচ্চিত্রের দৃশ্যে প্রবেশ করেছেন। পুরনো গির্জা, অফিস, ব্রিটিশ গভর্নরের বাসভবন, ওয়াইন সেলার, সুইমিং পুল, বেকারি— সবই আজ ধ্বংসপ্রায়, কিন্তু প্রকৃতি এগুলিকে নিজের করে নিয়েছে।

গাছের শিকড় পুরনো ইট-দেয়াল জড়িয়ে ধরেছে, আর সূর্যের আলো ছায়ার খেলায় সেই নিঃসঙ্গ স্থাপনাগুলিকে করে তুলেছে অদ্ভুত সুন্দর। দ্বীপের চারপাশে সমুদ্রের নীলাভ ঢেউ আর বাতাসের মৃদু শব্দ এক মায়াবী অনুভূতি সৃষ্টি করে।


🐒 বর্তমান রস আইল্যান্ড

আজ রস আইল্যান্ডে মানুষের বসবাস নেই, তবে সেখানে প্রচুর ময়ূর, হরিণ, খরগোশ ও পাখিরা স্বাধীনভাবে বিচরণ করে। পর্যটকরা এই দ্বীপে এসে প্রকৃতির সঙ্গে ইতিহাসের এক অনন্য মেলবন্ধন অনুভব করেন।
দ্বীপে বর্তমানে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি ছোট মিউজিয়াম রয়েছে — যেখানে রস আইল্যান্ডের ইতিহাসের নানা নিদর্শন সংরক্ষিত আছে।


📸 দর্শনীয় স্থানসমূহ

  1. Old Church Ruins:
    ইংরেজ আমলের এই গির্জা একসময় দ্বীপের গর্ব ছিল। এখন এর ছাদ নেই, কিন্তু শ্যাওলা-ঢাকা প্রাচীন দেওয়াল আজও সেই ইতিহাসের সাক্ষী।
  2. Chief Commissioner’s Residence:
    বিশাল এই ভবনটি একসময় ছিল ব্রিটিশ গভর্নরের আবাসভবন। এখন কেবল ধ্বংসাবশেষ, কিন্তু এখান থেকে সমুদ্রের দৃশ্য দেখা যায় অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর।
  3. The Lighthouse Point:
    রস আইল্যান্ডের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা লাইটহাউস থেকে দেখা যায় দূরবর্তী পোর্ট ব্লেয়ার, বোট আর সূর্যাস্তের স্বপ্নময় দৃশ্য।
  4. Japanese Bunkers:
    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা কিছুদিন এই দ্বীপে অবস্থান করেছিল। তাদের নির্মিত বাংকারগুলি আজও নিঃশব্দে সেই যুদ্ধের গল্প বলে।

🍃 প্রকৃতি ও নিস্তব্ধতার মেলবন্ধন

রস আইল্যান্ডে কোনও যানবাহন নেই। হাঁটলেই দেখা মেলে ছায়াঘেরা রাস্তা, বাতাসে লবণের গন্ধ আর সমুদ্রের ফিসফিসানি। মনে হয়, আপনি নয়, সময় নিজেই হাঁটছে আপনার পাশে।
প্রকৃতি আর ইতিহাস এখানে একে অপরের সঙ্গে কথা বলে — একটিতে আছে সৌন্দর্য, অন্যটিতে স্মৃতি।


🕰️ ভ্রমণের সেরা সময়

  • সেরা সময়: নভেম্বর থেকে এপ্রিল
  • আবহাওয়া: মনোরম, হালকা ঠান্ডা ও রৌদ্রোজ্জ্বল
  • ভ্রমণ সময়কাল: আধা দিনই যথেষ্ট পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখতে

🧭 ভ্রমণ টিপস

  • সকাল বা বিকেল বেলায় যান — আলোছায়ার খেলা সবচেয়ে সুন্দর দেখায়।
  • হালকা খাবার, পানি ও ক্যামেরা সঙ্গে রাখুন।
  • বন্য প্রাণীদের বিরক্ত করবেন না।
  • প্রবেশের আগে ফেরির সময়সূচি দেখে নিন।

🌅 উপসংহার

রস আইল্যান্ড শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয় — এটি এক সময়ের হারিয়ে যাওয়া রাজ্য। এখানে দাঁড়ালে মনে হয় ইতিহাস আপনার কানে কিছু বলছে, আর প্রকৃতি সেটিকে সুরে বেঁধে দিচ্ছে।

সেলুলার জেলের অন্ধকার স্মৃতির বিপরীতে রস আইল্যান্ড হলো সৌন্দর্যের এক আলোকিত অধ্যায়, যেখানে ধ্বংসের মধ্যেও সৃষ্টি আছে, আর নিঃসঙ্গতার মধ্যেও সৌন্দর্য।

যেমন কেউ একবার বলেছিলেন —

“রস আইল্যান্ডে গেলে আপনি শুধু সমুদ্র দেখবেন না, আপনি সময়ের গভীরতাও অনুভব করবেন।” 🌊

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *