ভারতের প্রাচীনতম শহর বারাণসী — যাকে কেউ বলে কাশী, কেউ বলে অন্নপূর্ণার নগরী, আবার কেউ বা বলে শিবের প্রিয় ভূমি।

ভারতের প্রাচীনতম শহর বারাণসী — যাকে কেউ বলে কাশী, কেউ বলে অন্নপূর্ণার নগরী, আবার কেউ বা বলে শিবের প্রিয় ভূমি। এই শহরের প্রাণ হল গঙ্গা নদী, আর তার বুক জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ঘাট — প্রতিটি ঘাট যেন এক একটি গল্প, এক একটি সাধনা, এক একটি যুগের নিঃশব্দ সাক্ষী।


🌅 ঘাটের প্রথম আলো — পবিত্রতার অনুভব

প্রভাতের আলো যখন গঙ্গার জলে পড়ে সোনালি আভা ছড়ায়, তখন বারাণসীর ঘাটে শুরু হয় জীবনের নতুন সুর। নৌকোয় বসে যখন ভক্তরা সূর্য নমস্কার করেন, তখন মনে হয় প্রকৃতি নিজেই প্রার্থনা করছে। সেই মুহূর্তে গঙ্গার ঢেউ, ঘণ্টাধ্বনি, শঙ্খনাদ আর মন্ত্রপাঠ একাকার হয়ে যায় — এক অদ্ভুত পবিত্র আবহে।


🚣‍♂️ ঘাট থেকে ঘাটে ইতিহাসের যাত্রা

বারাণসীতে প্রায় ৮০টিরও বেশি ঘাট রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হল দশাশ্বমেধ ঘাট, মানিকর্ণিকা ঘাট, হরিশচন্দ্র ঘাট, অসসী ঘাট, এবং পঞ্চগঙ্গা ঘাট

  • দশাশ্বমেধ ঘাট — বলা হয়, স্বয়ং ব্রহ্মা এখানে দশটি অশ্বযজ্ঞ সম্পন্ন করেছিলেন। সন্ধ্যায় এখানে অনুষ্ঠিত হয় বিখ্যাত গঙ্গা আরতি, যার আগুনের শিখা, ধূপের ধোঁয়া, আর ঢোলের তালে তালে ভেসে ওঠা ভক্তিগীতি যেন স্বর্গীয় অনুভূতি জাগায়।
  • মানিকর্ণিকা ঘাট — এটি হল মুক্তির দ্বার। এখানে জীবনের শেষ বিদায় ঘটে। কিন্তু বারাণসীর আকাশে মৃত্যুও শান্ত, কারণ এখানে মৃত্যু মানে মোক্ষের আলিঙ্গন।
  • অসসী ঘাট — এখানে নাকি মা অন্নপূর্ণা দেবী ও মহাদেব একত্রে বাস করতেন। সকালে এখানে স্নান করা মানে পাপমোচন।

🕉️ গঙ্গা আরতির মহিমা

প্রতিদিন সন্ধ্যা নামার পর দশাশ্বমেধ ঘাটে শুরু হয় গঙ্গা আরতি। সাদা পোশাকে সজ্জিত পুরোহিতরা একসঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণ করে আরতি করেন। বাতাসে তখন ভেসে আসে ধূপের গন্ধ, শঙ্খের ধ্বনি, আর গঙ্গার ঢেউয়ে প্রতিফলিত আগুনের আলো। সেই মুহূর্তে দর্শকরা যেন দেবলোকে প্রবেশ করেন। হাজারো ভক্ত, পর্যটক, সন্ন্যাসী—সকলেই তখন এক সুরে মিলিত হয় “গঙ্গা মাইয়া কি জয়!” ধ্বনিতে।


🪔 আধ্যাত্মিকতার স্পর্শ

গঙ্গা ঘাট শুধু দর্শনীয় স্থান নয়, এটি হল আত্মশুদ্ধির স্থান। এখানে বসে সাধু-সন্ন্যাসীরা ধ্যান করেন, কেউ কেউ যোগাভ্যাস করেন, কেউ বা পাঠ করেন উপনিষদ বা শিবপুরাণ। পর্যটকরাও এই অভিজ্ঞতায় নিজেদের হারিয়ে ফেলেন। অনেক বিদেশি পর্যটক বলেন — “বারাণসীর গঙ্গা ঘাটে বসে সময় থেমে যায়।”


🌺 উৎসব ও আনন্দের মেলা

গঙ্গা ঘাটে সারাবছর ধরে নানা উৎসব পালিত হয় — দীপাবলি, ছটপূজা, গঙ্গা দশেরা, মকর সংক্রান্তি, এমনকি হোলিতেও ঘাট হয়ে ওঠে উল্লাসের কেন্দ্র। হাজার হাজার মানুষ গঙ্গাস্নান করতে আসে, প্রদীপ ভাসায়, প্রার্থনা করে। সেই দৃশ্য যেন ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার চূড়ান্ত প্রকাশ।


🏞️ ভ্রমণ টিপস

  • কীভাবে যাবেন: বারাণসী স্টেশন থেকে অটো বা ট্যাক্সিতে সহজেই ঘাটে পৌঁছানো যায়।
  • ভ্রমণের সেরা সময়: অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত।
  • কি করবেন: সকালে সূর্যোদয়ের সময় নৌকাভ্রমণ অবশ্যই করুন। সন্ধ্যায় গঙ্গা আরতি উপভোগ করতে ভুলবেন না।

💫 সমাপ্তি

বারাণসীর গঙ্গা ঘাট কেবল নদীর পাড় নয় — এটি এক জীবন্ত উপাখ্যান, যেখানে জন্ম ও মৃত্যু মিলেমিশে আছে, যেখানে আধ্যাত্মিকতা আর বাস্তবতার সেতুবন্ধন ঘটে। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সময় থেমে গেছে, শুধু প্রবাহিত হচ্ছে গঙ্গা, আর তার সঙ্গে বয়ে যাচ্ছে মানব সভ্যতার অমর গল্প।

“গঙ্গা শুধু নদী নয়, সে ভারতীয় আত্মার চিরন্তন প্রতীক।”


 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *